আকিকার শরঈ দৃষ্টিকোণ
প্রশ্ন: আকিকার শরঈ দৃষ্টিকোণ কী? আকিকা কী? কখন করতে হবে?
আকিকার শরঈ দৃষ্টিকোণ
আকিকার আভিধানিক অর্থ হলো আল্লাহর কাছে নজরানা পেশ করা, শুকরিয়া আদায় করা, জানের সদকা দেওয়া ও আল্লাহর নিয়ামতের মোকাবেলায় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। শরীয়াহ মতে আকিকা হচ্ছে, সন্তান জন্ম গ্রহণের পর আল্লাহ তাআলার শুকরিয়া আদায়ের লক্ষ্যে জন্মের সপ্তম দিনে পশু যবাই করা।
ফুকাহায়ে কেরামের ভাষ্যমতে আকিকা করা মুস্তাহাব। সন্তান জন্মের পর আরো যেসব কাজ মুস্তাহাব তা হলো—জন্মের পর পরই বাচ্চার ডান কানে আযান এবং বাম কানে ইকামত দেওয়া। অতঃপর তাহনিক করানো। অতঃপর সপ্তম দিনে আকিকা করা। হাদিস এর প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আকীকা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন,‘‘যে ব্যক্তি সন্তানের আকিকা করার ইচ্ছা করে সে যেন তা পালন করে। ছেলের জন্য সমমানের দুটি ছাগল। আর মেয়ের জন্য একটি।’’ [মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক-৭৯৬১]
সপ্তম দিনে আকিকা করা—
আকিকার ব্যাপারে হাদিসে এসেছে,
‘নবজাতকের পক্ষ থেকে সপ্তম দিনে জবেহ করা হবে।’
تُذْبَحُ عَنْهُ يَوْمَ السّابِعِ.
[সুনানে আবু দাউদ-২৮৩৭, জামে তিরমিযী- ১৫২২, সুনানে ইবনে মাজাহ-৩১৬৫]
নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর দৌহিত্রদ্বয় হাসান ও হুসাইন রাযি.-এর আকীকা সপ্তম দিনে করেছেন। [সুনানে আবু দাউদ-২৮৩৪]
তাই সম্ভব হলে সপ্তম দিনেই আকীকা করা উত্তম।সপ্তম দিনে সম্ভব না হলে চৌদ্দতম দিনে বা একুশতম দিনে করা ভালো। উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রাযি. বলেন, আকীকা সপ্তম দিনে হওয়া উচিত। তা সম্ভব না হলে চৌদ্দতম দিনে। এবং তাও সম্ভব না হলে একুশতম দিনে। [মুসতাদরাকে হাকেম-৭৬৬৯]
অবশ্য একুশ দিনের মধ্যে করা না হলে পরবর্তীতেও তা আদায় করা যাবে। এমনকি কোনো ব্যক্তির যদি ছোটবেলায় আকিকা করা না হয়ে থাকে এবং সে বড় হয়ে নিজের আকিকা নিজে করতে চায় তাহলে সেটারও সুযোগ আছে। বিখ্যাত তাবেয়ী মুহাম্মাদ ইবনে সীরীন রাহ. বলেন, আমি যদি জানতাম যে, আমার আকীকা করা হয়নি তাহলে আমি নিজেই আমার আকীকা করতাম। [মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা-২৪৭১]
সপ্তম দিন যেভাবে গণনা করবে—
শরীয়তের যেসমস্ত মাসআলা দিন-তারিখ, মাস-বছরের সাথে সম্পৃক্ত সেগুলো চাঁদের হিসাবে গণনা করতে হয়। অতএব আকিকার সপ্তম দিন গণনা করতে হবে চাঁদের হিসাবে।
আর আমাদের জানা আছে যে, চাঁদের ক্ষেত্রে দিন/তারিখ শুরু হয় সূর্যাস্তের পর থেকে। এখন কোনো সন্তান যদি শনিবার সূর্যাস্তের পর জন্ম নিল তার অর্থ সে রবিবারে জন্ম নিল। সেক্ষেত্রে তার সাত দিন গণনা শুরু হবে রবিবার থেকে, শনিবার থেকে নয়। সে হিসাবে সপ্তম দিন হবে পরের শনিবার। কিন্তু যদি সাধারণ ধারণার ভিত্তিতে শনিবারকে প্রথম দিন ধরে গণনা করা হয় তাহলে সপ্তম দিন হবে জুমাবার; যা ভুল। হাঁ, যদি শনিবার সূর্যাস্তের আগে জন্ম নেয় তখন দিন গণনা শুরু হবে শনিবার থেকে। [মাসিক আল কাউসার]
সন্তানের আকিকা কার দায়িত্বে?
সন্তানের আকিকার দায়িত্ব বাবার। বাবার সামর্থ্য না থাকলে যদি মা সামর্থ্যবান হন তবে মা সন্তানের আকিকা করবেন। অবশ্য বাবা-মা সামর্থ্যবান হোক বা না হোক উভয় অবস্থায় তাদের সম্মতিতে দাদা, নানা বা যে কেউ আকিকা করলে আকীকা সহীহ হয়ে যাবে।
কতটি পশু আকিকা করবেন?
ছেলে সন্তানের জন্য দু’টি ছাগল আর কন্যার জন্য একটি ছাগল দিয়ে আকিকা করা উত্তম। উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রাযি. থেকে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লাম ছেলের পক্ষ থেকে দুটি ছাগল আর মেয়ের পক্ষ থেকে একটি ছাগল দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। [জামে তিরমিযী, হাদিস ১৫১৩]
তবে ছেলে সন্তানের ক্ষেত্রে একটি যবাই করলেও আকিকার হক আদায় হয়ে যাবে। এছাড়া উট, মহিষ, গরু ইত্যাদি দ্বারা আকিকা করা যায়। আনাস রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যার কোনো সন্তান জন্মলাভ করে সে যেন উট, গরু অথবা ছাগল দ্বারা আকীকা করে। [আলমুজামুল আওসাত ২/৩৭১]
এক গরুতে একাধিক সন্তানের আকিকা—
একটি গরু অথবা মহিষ বা উট দ্বারা তো একজনের আকিকা করা বৈধই আছে। যেমনটা উপরে বর্ণিত আনাস রাযি. এর হাদিস থেকে জানা যায়। আরো বর্ণিত আছে, হযরত আনাস রা. উট দ্বারা সন্তানদের আকিকা করেছেন। [তবারানী, কাবীর, হাদীস ৬৮৫; মাজমাউয যাওয়াইদ ৪/৯৪; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ২৪৭৫৫]
বাকী থাকলো প্রত্যেক সন্তানের জন্য একেকটি পশু দ্বারা আকিকা করা হবে, না কয়েকজনের জন্য একটি গরু-মহিষ দ্বারা আকিকা করলেও তা আদায় হয়ে যাবে—এটি একটি ইজতেহাদী মাসআলা। কোন কোন আলেমের মতে কুরবানীর মত আকিকাও কয়েকজনের জন্য একটি গরু বা মহীষ দ্বারা করা যাবে। উল্লেখ্য, গরু-মহিষ দ্বারা আকীকা করা জায়েয হলেও ছাগল দ্বারা আকীকা করা উত্তম। কেননা ছাগল দিয়ে আকীকা করার কথা হাদীস শরীফে বিশেষভাবে বর্ণিত হয়েছে।
কুরবানীর সাথে আকিকা করা—
কুরবানি ও আকিকা আলাদাভাবেই করা উচিৎ। তবে একত্রে করলে আদায় হবে না তা নয়। একত্রে করলেও কুরবানী আকিকা দুটোই আদায় হবে। কারণ আকীকাও এক ধরনের কুরবানী। হাদীস শরীফে আকীকার উপরও ‘নুসুক’ শব্দের প্রয়োগ হয়েছে।
বিখ্যাত তাবেয়ী ইমাম ‘আতা ইবনে আবী রাবাহ রহ. এর ফতোয়াটিই সম্ভবত বিজ্ঞজনের যথেষ্ট হবে। তিনি বলেছেন, ‘উট ও গরু সাতজনের পক্ষ হতে কুরবানী হতে পারে। আর এতে শরীক হতে পারে কুরবানীকারী, তামাত্তু হজ্বকারী এবং হজ্বের ইহরাম গ্রহণের পর হজ্ব আদায়ে অপারগ ব্যক্তি। (দ্র. আসসুনান, সায়ীদ ইবনে মানসূর-আল কিরা লি-কাসিদি উম্মিল কুরা, পৃ. ৫৭৩)
দেখুন সালাফের যুগেই একটি পশু দ্বারা তিন ধরনের কুরবানী আদায় হওয়ার ফতোয়া কত স্পষ্টভাবে দেওয়া হয়েছে। [মাসিক আল কাউসার]
আকিকার গোশত—
আকীকার গোশত সন্তানের পিতামাতা, আত্মীয়স্বজন সকলেই খেতে পারবে। হযরত আয়েশা রাযি. থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন, আকীকার গোশত নিজে খাবে, অন্যকে খাওয়াবে এবং কিছু সদকা করবে। মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস ৭৬৬৯
-মুফতী মুহাম্মাদ খাইরুল ইসলাম