সর্বশেষ আন্তর্জাতিক রাজনীতি অর্থনীতি দেশ

চোখের সামনে টেবিলে সাজানো রসগোল্লা, মিষ্টি দই আর পায়েস। একসময় যেগুলোর স্বাদে উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়ত পুরো ঘরে, এখন সেগুলোর দিকেই তাকাতে ভয় পান শাহনাজ পারভীন। ৫২ বছর বয়সী এই নারী জানেন—এই এক চামচ মিষ্টিই তার জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে। পাঁচ বছর ধরে ডায়াবেটিসে ভুগছেন তিনি। চিকিৎসক কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন চিনি বা মিষ্টিজাত খাবার খেতে। ‘আগে ঈদে বা পহেলা বৈশাখে নিজের হাতে পায়েস রান্না করতাম। এখন রান্না করি, কিন্তু খেতে পারি না। সবাই খায়, আমি শুধু দেখি। মনে হয় জীবনটা যেন স্বাদহীন হয়ে গেছে,’ বললেন শাহনাজ।

দেশে এখন প্রায় এক কোটি ৪০ লাখ মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে ডায়াবেটিসের প্রবণতা সবচেয়ে দ্রুত বাড়ছে। দেশের প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর প্রায় ১৩ শতাংশই কোনো না কোনোভাবে এই রোগে ভুগছেন। প্রতি বছর নতুন করে প্রায় ৬ লাখ মানুষ যুক্ত হচ্ছেন এই তালিকায়। ডায়াবেটিস এক সময়কে বলা হতো ধনীদের রোগ। কিন্তু এখন শহর থেকে গ্রাম, শ্রমজীবী থেকে শিক্ষিত পেশাজীবী-সব শ্রেণির মানুষই আক্রান্ত হচ্ছেন। খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন, শারীরিক পরিশ্রমের অভাব, ফাস্ট ফুডের ঝোঁক, ওজন বৃদ্ধি ও মানসিক চাপ-সব মিলিয়ে ডায়াবেটিস এখন নীরব মহামারি।

মিরপুরের ব্যবসায়ী হারুন অর রশিদ, বয়স ৪৭। সকালে ঘুম থেকে উঠেই চা ছাড়া তার দিন শুরু হয় না। আগে প্রতিদিন ৮–১০ কাপ চা খেতেন, প্রতিটাতেই দুই চামচ চিনি। এখন একেবারে চিনি ছাড়া চা খেতে হয়। ‘চিনি ছাড়া চা পানির মতো লাগে। কিন্তু চিকিৎসক বলেছেন, চিনি খেলেই বিপদ। তাই বাধ্য হয়েই খাই,’ বললেন তিনি।

ডায়াবেটিস শুধু শারীরিক নয়, মানসিকভাবেও মানুষকে ক্লান্ত করে তোলে। বিশেষ করে যারা আগে মিষ্টিজাত খাবারের ভক্ত ছিলেন, তাদের জন্য জীবনযাত্রার এই পরিবর্তনটা কষ্টকর। খাদ্য নিয়ন্ত্রণ, নিয়মিত ওষুধ সেবন, ব্যায়াম, ওজন নিয়ন্ত্রণ-সব মিলিয়ে একধরনের শৃঙ্খলিত জীবনযাপন করতে হয়। এতে অনেকেই মনে করেন, তারা যেন নিজেদের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, চিকিৎসকরা জানান তাদের কাছে অনেক রোগী এসে বলেন-‘ডাক্তারের কথা মতো সব মানি, কিন্তু মনে হয় জীবনটা আনন্দহীন।’ আসলে ডায়াবেটিস এমন এক রোগ, যেখানে শরীরের পাশাপাশি মনকেও নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়।

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো জীবনযাত্রা। প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে খাবার খাওয়া, পর্যাপ্ত ঘুম, হাঁটা বা ব্যায়াম এবং চিনি ও কার্বোহাইড্রেট কমানো—এই চারটি নিয়ম মানলে রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। কিন্তু বাস্তবে বেশির ভাগ মানুষই দীর্ঘমেয়াদে এই নিয়ম মানতে পারেন না। বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির (বাডাস) তথ্য অনুযায়ী, প্রতি তিনজন রোগীর একজন নিয়মিত চিকিৎসকের কাছে যান না। আবার যাদের ডায়াবেটিস আছে, তাদের প্রায় অর্ধেকই জানেন না যে, তারা এ রোগে ভুগছেন। ফলে জটিলতা বাড়ে—চোখের দৃষ্টি কমে যাওয়া, কিডনি নষ্ট হওয়া, হৃদরোগ ও স্নায়ুর সমস্যা দেখা দেয়।

অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এখন কোনো দাওয়াতে যেতে মন চায় না। সবাই মিষ্টি পরিবেশন করে, আমি না খেলে খারাপ লাগে। তাই না যাওয়াই ভালো মনে করি।’

চিকিৎসকদের মতে, এই মানসিক সংকোচন ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে বেশ সাধারণ। কেউ কেউ অতিরিক্ত ভয় পেয়ে সম্পূর্ণ চিনি বাদ দিয়ে ফেলেন, ফলে শরীরে শক্তির ঘাটতি দেখা দেয়। আবার কেউ আবার আত্মনিয়ন্ত্রণ হারিয়ে অতিরিক্ত মিষ্টি খেয়ে বিপদ ডেকে আনেন। বিশ্ব ডায়াবেটিস ফেডারেশনের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ২০৪৫ সালের মধ্যে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ২ কোটি ৩০ লাখে। বর্তমানে ৪০ বছরের নিচের বয়সীদের মধ্যেও রোগটির হার আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে।

পুষ্টিবিদ সাবরিনা রহমান বলেন, ‘আগে যেভাবে আমরা মিষ্টি খেতাম, সেটা এখনকার প্রেক্ষাপটে বিপজ্জনক। অনেকেই বলেন, চিনি বাদ দিলে জীবনের আনন্দই শেষ হয়ে যায়। কিন্তু আসলে বিকল্প স্বাদও তৈরি করা সম্ভব-যেমন স্টেভিয়া বা প্রাকৃতিক সুইটনার ব্যবহার।’

তবে এসব বিকল্প খাবার এখনো সবার নাগালের মধ্যে আসেনি। বাজারে ‘ডায়াবেটিক ফ্রেন্ডলি’ লেখা মিষ্টি বা কেক পাওয়া গেলেও সেগুলোর দাম অনেক বেশি। সাধারণ মানুষের জন্য নিয়মিত কেনা সম্ভব নয়। ফলে রোগীরা বিকল্প স্বাদের চেষ্টাও ছেড়ে দেন।

ঢাকা মেডিকেল কলেজের এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. এম সাইফুদ্দিন বলেন, ‘ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য সুষম খাদ্য একটি অপরিহার্য দিক। সারা দিনের খাবারে ৫০ শতাংশ কার্বোহাইড্রেট, ১০-১৫ শতাংশ প্রোটিন এবং বাকি ৩৫ শতাংশ ফ্যাট থাকা উচিত। একটি আদর্শ প্লেট মডেলের মাধ্যমে রোগীদের বোঝানো হয়, যেখানে প্লেটের অর্ধেক থাকবে শাকসবজি, এক–চতুর্থাংশ থাকবে কার্বোহাইড্রেট (ভাত–রুটি) এবং আরেক চতুর্থাংশ প্রোটিন। ডায়াবেটিক রোগীদের আমরা দিনে তিনটি বড় খাবার এবং তিনটি স্ন্যাকস খাওয়ার পরামর্শ দিই। এর মধ্যে সকালে ৮টায় নাশতা, বেলা ১১টায় হালকা খাবার, বেলা ২টায় মধ্যাহ্নভোজ, বিকেল ৫টায় হালকা স্ন্যাকস, রাত ৮টায় ডিনার এবং রাত ১১টায় ঘুমানোর আগে হালকা খাবার খাওয়ার নিয়ম মেনে চলা উচিত। অল্প করে বারবার খেলে রক্তে শর্করার ওঠানামা কম হয়। সবাইকে আঁশযুক্ত খাবার গ্রহণের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।’

বাংলাদেশে ডায়াবেটিস রোগীদের চিকিৎসা ব্যয়ও বাড়ছে। বাডাসের এক সমীক্ষায় দেখা যায়, একজন ডায়াবেটিস রোগীর মাসিক চিকিৎসা ব্যয় গড়ে তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা। ইনসুলিন, ওষুধ, রক্তপরীক্ষা ও বিশেষ খাদ্য কিনতে গিয়ে অনেকেই আর্থিকভাবে চাপে পড়ছেন। গ্রামীণ এলাকায় পরিস্থিতি আরও কঠিন, কারণ সেখানে চিকিৎসক ও ডায়াবেটিস ক্লিনিকের অভাব রয়েছে। চিকিৎসকরা বলছেন, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব, যদি নিয়ম মেনে চলা যায়। রোগীরা যদি চিনি পুরোপুরি বাদ না দিয়ে সীমিত রাখেন, নিয়মিত ব্যায়াম করেন ও ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখেন, তবে তারা স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন। কিন্তু ভয় বা অনিয়ম—দুটির যেকোনো একটিই বিপদের কারণ।

গুলশানের বাসিন্দা নুরুল আলম বলেন, ‘আগে সকাল শুরু হতো পরোটা আর চায়ে চিনি মিশিয়ে। এখন সকালে খাই ওটস আর চিনি ছাড়া কফি। শরীর ভালো থাকে, কিন্তু মনে হয় জীবনটা রঙহীন হয়ে গেছে।’

ডায়াবেটিস আসলে একধরনের জীবনধারাজনিত রোগ। এটি পুরোপুরি নিরাময় সম্ভব নয়, তবে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। কিন্তু এর প্রভাব শুধু শরীরে নয়, মনে ও সমাজে ছড়িয়ে পড়ে। এক সময়ের প্রাণবন্ত মানুষগুলো খাবারের টেবিলেও এখন নীরব। চোখের সামনে প্রিয় মিষ্টি, কিন্তু তা ছোঁয়ারও সাহস নেই। ডায়াবেটিস হয়তো চিকিৎসা ও নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, কিন্তু এটি যে জীবনের আনন্দ কেড়ে নেয়—তা অস্বীকার করার উপায় নেই। খাবারের স্বাদহীনতা যেন ধীরে ধীরে জীবনেরই স্বাদ কেড়ে নিচ্ছে। তবুও এই স্বাদহীন জীবনের ভেতরেই টিকে থাকার লড়াই চলছে লাখো মানুষের।

আরও পড়ুন...

জনপ্রিয়

সর্বশেষ খবর