সর্বশেষ আন্তর্জাতিক রাজনীতি অর্থনীতি দেশ

স্মরণ : মাওলানা সাইয়্যিদ মাহমুদ মাদানী

ফিদায়ে মিল্লাত আসআদ মাদানির কোরআন প্রেম

উপমহাদেশের আধ্যাত্মিক রাহবার ফিদায়ে মিল্লাত আসআদ মাদানি রহ. সন্তানদের তারবিয়্যাতের ক্ষেত্রে অত্যন্ত কঠোর ছিলেন। আর তারবিয়্যাতের প্রশ্নে তাঁর কোনোধরনের নমনীয় মনোভাব ছিল না। অথচ ছোট শিশুদের প্রতি অত্যধিক মমতাময় ছিলেন। কিন্তু তারবিয়্যাতের বিষয়ে অত্যন্ত কঠোর এবং মৌলিক দৃষ্টিকোণ থেকে এক ইঞ্চিও নড়েননি। যদিও সন্তানদের খাবার-দাবার, কাপড়-চোপড়, চিকিৎসা ও সুস্থতার প্রতি অধিক যত্নবান ছিলেন। যে করেই হোক স্বাস্থ্য যেন খারাপ না হয়। সেদিকে খেয়াল রাখতেন। কিন্তু যেহেতু তার সফর হত খুব বেশি, বাড়ির বাইরেই কাটাতেন অধিকাংশ সময় আর বাড়িতে আসতেন মেহমানের মতো, তাই আমাদেরকে পড়াশোনার জন্য আমাদের ফুফাজানের (হযরত ক্বারী মুহাম্মদ উসমান সাহেব) হাওয়ালা করেছিলেন। হিফজও আমি তাঁর কাছেই করেছি। তিনি তখন ‘আমরোহ’ থাকতেন। পরে তিনি যখন দেওবন্দ চলে এলেন তখন আমরাও দেওবন্দে চলে এলাম। সেসময় থেকে বাড়িতে অবস্থানের সুযোগ পাওয়া গেল। নচেৎ শৈশব থেকেই বাড়ি থেকে আলাদা ছিলাম। আমাদের তো বাড়িতে থাকার সুযোগ হলো বটে, কিন্তু তিনি সেই সুযোগ পেলেন না।

কুরআনে কারীমের প্রতি আমাদের হযরতের মহব্বত ছিল অপরিসীম। যদিও হাফিজ ছিলেন না তিনি, দেখেদেখে পড়তেন। কিন্তু কুরআনে কারীম এতবেশী তেলাওয়াত করতেন; অনেক সময় এমনও হয়েছে যে, কেউ কুরআনে কারীম শুনাচ্ছে বা মুখস্থ তেলাওয়াত করছে আর তিনি বসে আছেন। তেলাওয়াতকারী ভুল পড়ছে; তাঁর সামনে কুরআন নেই তারপরও সাথে সাথে ভুল ধরিয়ে দিচ্ছেন; ‘দেখ’। কুরআনে কারীমের সাথে তাঁর সীমাতীত সম্পর্কের এটাই ছিল নমুনা। হাফিজ না হওয়া সত্ত্বেও অন্যের ভুল তেলাওয়াতে সতর্ক করে দিতেন। পরিবারের, নিজ সন্তানদের কিংবা আত্মীয়-স্বজনের কারো যদি হিফজে কুরআন সম্পন্ন হতো, তাহলে এরচেয়ে আনন্দের দিন আর ছিল না তাঁর কাছে। আমার নিজের ছোটবেলার ঘটনা স্মরণ আছে, আমার ওয়ালেদা মরহুমাকে হযরত বলছিলেন, ‘এ বছর আমরা মাহমুদের কুরআন তেলাওয়াত নফল নামাযে শুনব। আর তা হবে তাহাজ্জুদের সময় নফলে, আবার তন্মধ্যে সবচেয়ে প্রথম, দ্বিতীয় নম্বর অর্ধরাত্রিতে আমরা শুরু করব। রমজানে আমাদের এখানে কাজ হলো, ৪/৫ জন হাফিজ নফল নামাযে দাঁড়িয়ে কুরআনে কারীম শুনান। তখন গরমের মৌসূম ছিল, তাই রাত একটা থেকেই ধারাবাহিক ভাবে শুরু হয়ে যেত। যেহেতু আমি তখন ছোট ছিলাম তাই আমার নম্বর শুরুতে পড়ত। তাই মানা করে দিলাম যে, আমি শুনাব না। ওয়ালেদা মরহুমাকে মানা করে শুয়ে পড়লাম। গরমের মৌসুম ছিল, বাইরে বারান্দায় শুয়েছিলাম। হযরত রহ. তাশরীফ আনলেন এবং আমাকে জাগালেন, ‘মাহমুদ! উঠো, নফল নামাযের জন্য যেতে হবে’। আমি এতে মানা করলাম না, উঠে ওজু করে চলে গেলাম। এতে তাঁর মননে এত প্রভাব পড়েছিল, তিনি বারবার বলছিলেন, দেখ! আমাকে তো সে একেবারেই মানা করেনি, দেখ! সে তো চলে গেল। তিনি মনে করেছিলেন, মা কে যেমন মানা করেছে তেমনি আমাকেও মানা করবে। তাই আমার কুরআন শুনানোয় তিনি অত্যন্ত খুশি হয়েছিলেন। সে বছর যখন নফল নামাযে কুরআনে কারীম খতম করলাম; তিনি আমাকে টাকাও দিয়েছিলেন।

অনুরূপভাবে পরের প্রজন্ম আমার ছেলে ‘হুসাইন’-এর কুরআনে কারীমের হিফজ সম্পন্ন হলো, এই উপলক্ষ্যে আমি সব আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধবকে দাওয়াত করি, তখন হযরত রহ. নিজে লোকজনের তালিকা তৈরীতে সহযোগিতা করেন। অমুককে দাওয়াত কর, তমুককে দাওয়াত কর। যখন তার হিফজ শেষ হচ্ছিল তখন যোহরের আগেই আমাকে বললেন, তার মাথায় পাগড়ি বাঁধবে না? আমাকে দিয়ে নিজের আলমারি খুলালেন, আমি একটি সাদা রুমাল বের করে দিলাম, বললেন, না, আরেকটি বের কর, অন্যটি বের করলাম, বুঝলাম না, বললেন, আরেকটি বের কর, তখন সোনালী রঙের নকশা করা একটি পাগড়ী বের করলাম, বললেন, ‘হ্যাঁ’ এটাই উত্তম হবে’। খতমের পর তা নিজ হাতে তার মাথায় বেঁধে দিলেন। এরপর যখন দুআ করছিলেন, অনেক কেঁদে অত্যন্ত প্রাণখুলে নিমগ্নতার সাথে দুআ করছিলেন। তাঁর নিজ সন্তানের কিংবা আত্মীয়দের সন্তানদের কারো কুরআনে কারীমের হিফজ সম্পন্ন হওয়া হযরতের জন্য সবচেয়ে আনন্দ ও খুশির বিষয় ছিল। আর কোনো বিষয় এরচেয়ে মূল্যবান ছিল না তাঁর কাছে।

আমার ছোটবেলার কথা স্মরণ আছে, আমরা তো ভাবতেও পারি না, পিঠানোর মতো শাসন হতো। একবার নানি মরহুমা বলছিলেন, ‘সে অসুস্থ থাকে (আমার ছোটবেলা পলিও হয়েছিল, এর চিকিৎসা চলছিল) তার হিফজ পড়ানো বন্ধ করে দেওয়া যায়’, তিনি বললেন, ‘হিফজ শুরু হয়ে গেছে, এখন তা পূর্ণ হবে ইনশাআল্লাহ’, নানী মরহুমা আরো একটু অনুযোগ করলেন, ‘বাচ্চা তো মরে যাবে’, বললেন, ‘হ্যাঁ, ঠিক আছে হিফজ শেষ না করে যদি মাঝখানে ছেড়ে দেয়। তাহলে এরচেয়ে মরে যাওয়া ভালো, কিন্তু এখন পড়ছে এটা সম্পন্ন করবেই’। তাই আজ আমার কুরআনে কারীম যেটুকুই স্মরণে আছে এতে আমাদের হযরতের মহান অবদান রয়েছে। রমজানের রুটিন সবসময়ই এরকম ছিল যে, পুরো রমজান মাসই তিনি বাড়িতে অবস্থান করতেন। আসরের পরে যে দাওর হতো সেখানে তিনি নিজে বসতেন। কুরআনে কারীম খুলে সামনে রাখতেন, আর দাওর হতো। নিয়মটা এরকম ছিল যে, প্রথম চতুর্থাংশ আমি পড়তাম, অতঃপর প্রথম অর্ধেক ‘ছোট বাবু’ (হযরত মাওলানা আরশাদ সাহেব) কিংবা হযরত কারী উসমান সাহেব পড়তেন। আলহামদুল্লিাহ, এই অধমের এমন সৌভাগ্য হাসিল হয়েছে বাইশ বছরেরও অধিক কাল; যখন থেকে হাফিজ হয়েছি। আমি তারাবিহ শুরু করলাম, প্রথম তারাবিহ তো মহিলাদেরকে পড়িয়ে ছিলাম। শ্রোতা ছিলেন মাওলানা আসআদ সাহেব দিরয়াবী। এর পরের বছর থেকে হযরতকে তারাবিতে কুরআনে কারীম শুনানো শুরু করি। পরে মাঝে দু’বছর এমন গেছে, আমি কুরআনে কারীম শুনাতে পারিনি। যদি তখনও শুনাতাম তাহলে চব্বিশ বছর হতো। আল্লাহর করমে বাইশ বছর হযরতকে কুরআনে কারীম শুনিয়েছি। নফল নামাযেও এমনই হবে, মাঝে এক-দেড় বছর ছুটেছে। কিন্তু ইন্তিকালের বছর আমি তাঁকে তারাবিতে কুরআনে কারীম শুনাতে পারিনি। কারণ, কাশ্মীরে ভূমিকম্প হয়েছিল। আমি সেখানে রিলিফের কাজে চলে গিয়েছিলাম।

কুরআনে কারীমের প্রতি তাঁর যে জয্বা এবং আত্মিক সম্পর্ক ছিল তা আমি প্রত্যক্ষ করেছি, ফজরের আগে তাহাজ্জুদ এবং শেষ বয়সে বিশেষ করে তাহাজ্জুদ থেকে অবসর হয়ে নামাজের সময় পর্যন্ত বসে কুরআনে কারীম তেলাওয়াত করতেন। রমজানে তাঁর মা‘মুলাতের মাঝে সাধারণতঃ দৈনিক দশ পারা তো পড়তেনই এবং শেষ দশকে আরো বেড়ে যেত। এর সঠিক পরিমাণ তিনি প্রকাশ হতে দিতেন না। কেউ জিজ্ঞেস করলেও হেসে তা এড়িয়ে যেতেন।

(ফিদায়েমিল্লাত সেমিনার-নিউ দিল্লীতে প্রদত্ত ভাষণ। সংকলক : মুফতী সালমান মানসুরপুরী। প্রকাশক : জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ)

সেক্রেটারী জেনারেল, জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ

ভাষান্তর : মুহাম্মদ মাজহারুল হক চৌধুরী

আরও পড়ুন...

জনপ্রিয়

সর্বশেষ খবর