আঞ্চলিক রাজনীতিতে তালেবান: প্রতিবেশীদের নীরব যুদ্ধ
তালেবান ২০২১ সালে কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর আফগানিস্তানের প্রতি বিশ্বের মনোভাব দুই ভাগে বিভক্ত হয়েছে। একদিকে পশ্চিমা দেশগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন, নারী শিক্ষার ওপর নিষেধাজ্ঞা এবং জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। অন্যদিকে, ভারতের মতো দেশগুলো শঙ্কিত যে আফগানিস্তান ফের একটি জঙ্গি-আশ্রয়স্থলে পরিণত হচ্ছে। কিন্তু এই বাস্তবতা স্বত্বেও চীন, রাশিয়া, ইরান, পাকিস্তান—এমনকি ভারত পর্যন্ত—তালেবান সরকারের সঙ্গে সংলাপে লিপ্ত।
এই রাষ্ট্রগুলো ‘আন্তঃআফগান সংলাপ’, ‘শান্তিপূর্ণ অন্তর্ভুক্তিমূলক সরকার’ কিংবা ‘জাতীয় ঐকমত্য’—এইসব শব্দবন্ধ ব্যবহার করলেও বাস্তবে সবাই নিজেদের কৌশলগত স্বার্থ রক্ষায় তালেবানকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। এই বহুমুখী চেষ্টার মধ্য দিয়ে দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার ভূরাজনীতিতে নতুন এক ভারসাম্য রচিত হচ্ছে।
পাকিস্তান: মোহভঙ্গ ও নিরাপত্তা হুমকি
পাকিস্তান দীর্ঘদিন তালেবানকে মদদ দিয়েছে। তারা আশা করেছিল, তালেবান ক্ষমতায় এলে ইসলামাবাদের অনুগত একটি সরকার গঠিত হবে। কিন্তু বাস্তবে হয়েছে উল্টো। তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) তালেবান-শাসিত আফগানিস্তান থেকে পাকিস্তানে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। কাবুল এই গোষ্ঠীকে দমন করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে, যা পাকিস্তানের হতাশা আরও বাড়িয়েছে। ইসলামাবাদ এখন সীমান্তে কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে এবং আফগান শরনার্থীদের দেশে ফেরত পাঠাচ্ছে, যদিও এতে উভয় পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা আরও বেড়েছে।
চীন: স্থিতিশীলতা ও খনিজ সম্পদে আগ্রহ
চীনের মূল উদ্বেগ দুটি: নিরাপত্তা ও অর্থনীতি। বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI)-এর অন্তর্ভুক্ত চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডর (CPEC) আফগান সীমান্তের খুব কাছ দিয়ে গেছে। তালেবান-শাসিত আফগানিস্তান অস্থিতিশীল হলে এই প্রকল্প হুমকির মুখে পড়তে পারে। এছাড়া চীন আফগানিস্তানের বিশাল খনিজ সম্পদে আগ্রহী, বিশেষত লিথিয়াম, তামা ও অন্যান্য দুর্লভ খনিজ পদার্থে। তালেবান সরকারও চীনের বিনিয়োগ আকর্ষণে আগ্রহী। তবে বাণিজ্যিক চুক্তির চেয়ে চীন এখনই স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করাকেই প্রাধান্য দিচ্ছে।
ইরান: সীমান্ত নিরাপত্তা ও জাতিগত সমীকরণ
ইরান ও তালেবানের সম্পর্ক বরাবরই জটিল। ১৯৯৮ সালে তালেবান কূটনৈতিকভাবে ইরানিদের হত্যা করে দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টি করেছিল। আজও ইরান হেজারা ও শিয়া সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন, যাদের তালেবান দীর্ঘদিন ধরে দমন করে এসেছে। একই সঙ্গে আফগানিস্তান থেকে জল প্রবাহ কমে যাওয়া ইরানকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, বিশেষ করে হেলমান্দ নদীর জলবন্টন নিয়ে দ্বন্দ্ব চলছে। তবুও ইরান কৌশলগতভাবে তালেবান সরকারের সঙ্গে সীমিত যোগাযোগ বজায় রেখেছে, কারণ আফগানিস্তানে একচেটিয়া প্রভাব চীন বা পাকিস্তানের হাতে চলে যাওয়া তেহরানের জন্যও অগ্রহণযোগ্য।
ভারত: দূতাবাস চালু, কিন্তু সংলাপে সতর্কতা
ভারত ২০০১-২০২১ সালের মধ্যে আফগানিস্তানে ৩ বিলিয়ন ডলারের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে, যার মধ্যে সড়ক, হাসপাতাল, স্কুল, এমনকি সংসদ ভবন নির্মাণও অন্তর্ভুক্ত। তালেবান ক্ষমতায় এলে ভারত প্রথমে কাবুল থেকে তার কূটনীতিকদের সরিয়ে নেয়। তবে ২০২২ সালে ভারত কাবুলে ‘কারিগরি মিশন’ (টেকনিক্যাল মিশন) পাঠায়, যা কার্যত একটি সীমিত দূতাবাস হিসেবে কাজ করছে।
ভারত এখনো তালেবানকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়নি, কিন্তু হুমকি ও বাস্তবতার নিরিখে নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রাখছে। দিল্লি চায় না আফগানিস্তান ফের ভারত-বিরোধী সন্ত্রাসবাদের ঘাঁটি হয়ে উঠুক। একদিকে, ভারত তাজিক ও হেজারা গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে ঐতিহাসিক সম্পর্ক বজায় রাখছে, অন্যদিকে তালেবানের সঙ্গে ন্যূনতম যোগাযোগ রেখে কৌশলগত অবস্থানও সুরক্ষিত রাখছে।
তালেবান শাসনের অধীনে আফগানিস্তানকে ঘিরে আঞ্চলিক কূটনীতি এক নতুন রূপ নিচ্ছে। সব দেশই নিজেদের নিরাপত্তা, অর্থনীতি ও প্রভাব বিস্তারের হিসাব কষছে। এই জটিল ও বহুস্তর বিশ্লেষণের মাঝে তালেবান সরকারও চেষ্টা করছে তাদের আঞ্চলিক বৈধতা ও রাজনৈতিক অবস্থান মজবুত করতে। বিশ্ব স্বীকৃতি না থাকলেও, প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সংলাপ ও কৌশলগত লেনদেনের মাধ্যমে তালেবান এক নতুন কূটনৈতিক বাস্তবতা তৈরি করেছে