সীমান্ত নয়, যেন মৃত্যুর রেখা: নিয়ন্ত্রণরেখায় বাড়ছে অনিশ্চয়তা
ভারত ও পাকিস্তানকে বিভাজনকারী নিয়ন্ত্রণরেখার (Line of Control) কাছে বসবাস করার অর্থ যেন এক অনিশ্চিত জীবন যাপন। সব সময়ই সংঘাতের আশঙ্কা তাঁদের ঘিরে থাকে। সেখানে শান্তি যেন এই আছে, এই নেই।
সম্প্রতি জম্মু-কাশ্মীরের পেহেলগামে পর্যটকদের ওপর বন্দুকধারীর হামলার পর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। নয়াদিল্লি তাৎক্ষণিকভাবে পানিবণ্টন চুক্তি স্থগিত করে। পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় ইসলামাবাদ হুঁশিয়ারি দেয়, তারা ১৯৭২ সালের সিমলা চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসবে—যে চুক্তি নিয়ন্ত্রণরেখাকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছিল।
এরই মধ্যে নিয়ন্ত্রণরেখার দুই পাশে গোলাবর্ষণের ঘটনা ঘটে। ভারতের পক্ষ থেকে অন্তত ১৬ জন নিহতের খবর পাওয়া গেছে। পাকিস্তানের দাবি, তাদের পক্ষেও ৪০ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন। যদিও এসব প্রাণহানির সুনির্দিষ্ট সংখ্যা এখনো নির্ধারিত নয়।
নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর গোলাবর্ষণের ফলে দুই দেশের সীমান্তবর্তী এলাকার ঘরবাড়ি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়, গবাদিপশু ও জীবিকা নষ্ট হয়, সাধারণ মানুষ বাংকারে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। কানাডাপ্রবাসী পাকিস্তানি লেখক আনাম জাকারিয়া বলেন, সীমান্তের এই পরিস্থিতি দুই দেশের সামরিক খেয়ালখুশির শিকার করে সাধারণ মানুষকে। তাঁর মতে, কাশ্মীরিদের মতামত উপেক্ষা করেই ভারত ও পাকিস্তান নিজেদের মতো করে এই রেখা নির্ধারণ করেছে।
কাশ্মীর ঘিরে ভারত ও পাকিস্তানের দীর্ঘদিনের বিরোধে নিয়ন্ত্রণরেখা বারবার রক্তাক্ত হয়েছে। ২০০৩ সালে যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরের পর কিছু সময় শান্তি বজায় থাকলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। সর্বশেষ ২০২১ সালের চুক্তির পর প্রায় চার বছর অপেক্ষাকৃত স্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করেছিল। তবে এবারের সংঘাত সেই ক্ষীণ শান্তিকেও ভেঙে দিয়েছে।
কার্নেগি ইন্ডিয়ার বিশ্লেষক সূর্য ভালিয়াপ্পান কৃষ্ণ মনে করেন, এই উত্তেজনা তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সীমান্তে বড় ধরনের সংঘাতের ঘটনা কমে এসেছিল। তাঁর মতে, যুদ্ধবিরতির লঙ্ঘন অনেক সময় কেন্দ্রীয় নির্দেশনায় না ঘটলেও, মাঠপর্যায়ের সামরিক বাস্তবতা এর পেছনে কাজ করে।
দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হ্যাপিমন জ্যাকব তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, দুই পক্ষই আধুনিক ও শক্তিশালী অস্ত্র ব্যবহার করে। তবু এসব বিষয় নীতিনির্ধারকদের আলোচনায় তেমন স্থান পায় না।
লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের অধ্যাপক সুমন্ত্র বসুর মতে, নিয়ন্ত্রণরেখাকে আন্তর্জাতিক সীমান্তে রূপান্তরের প্রস্তাব বহুবার এসেছে, কিন্তু সেটি বাস্তবসম্মত নয়। কারণ, কাশ্মীর ইস্যুতে দুই দেশের রাজনৈতিক অবস্থান এখনো তীব্রভাবে বিপরীতমুখী।
সাম্প্রতিক সংঘাত আবারও মনে করিয়ে দিয়েছে—যখন জানালার ওপারে যুদ্ধক্ষেত্র, তখন শান্তি আসলে কতটা ভঙ্গুর হয়ে পড়ে।
তথ্যসূত্র:
বিবিসি উর্দু
বিবিসি বাংলা
Carnegie India
লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস
বই: Line on Fire (HappyMon Jacob), Kashmir: Roots of Conflict, Paths to Peace (Sumanttra Bose)