পাঁচ ইসলামী ব্যাংক একীভূতকরণ: গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের ঘোষণা ও সম্পদ উদ্ধারের রোডম্যাপ
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর এক সংবাদ সম্মেলনে বেসরকারি খাতের পাঁচটি ইসলামী ব্যাংকের একীভূতকরণ পরিকল্পনা ও ঋণপচা সম্পদ উদ্ধারের রূপরেখা উপস্থাপন করেছেন। ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার এবং অর্থ পাচার প্রতিরোধের লক্ষ্যে গৃহীত এই উদ্যোগকে তিনি একটি ‘ব্যাপক সংস্কার প্রক্রিয়া’ হিসেবে অভিহিত করেছেন।
একীভূতকরণের কাঠামো
নতুনভাবে প্রস্তাবিত শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকে একত্রিত হচ্ছে পাঁচটি ব্যাংক:
সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক
গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক
ইউনিয়ন ব্যাংক
এক্সিম ব্যাংক
এই একীভূতকরণ জুলাই থেকে অক্টোবর ২০২৫ এর মধ্যে সম্পন্ন করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
সরকার নতুন ব্যাংকটির প্রাথমিক মূলধন সরবরাহ করবে।
প্রধান লক্ষ্য হবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের (SME) অর্থায়ন।
গ্রাহকদের হিসাব ও সেবা স্বয়ংক্রিয়ভাবে নতুন ব্যাংকে স্থানান্তরিত হবে, লেনদেনে কোনো বিঘ্ন ঘটবে না।
শাখাগুলো ধাপে ধাপে একীভূত করা হবে এবং অতিরিক্ত শহরভিত্তিক শাখাগুলোকে গ্রামীণ এলাকায় স্থানান্তরের পরিকল্পনা রয়েছে।
গভর্নর স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন, এটি কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচির অংশ নয়, বরং চলমান একটি নীতিনির্ভর সংস্কার প্রক্রিয়া। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন, ভবিষ্যত সরকারও এই পদক্ষেপকে সমর্থন করবে।
কর্মী নিরাপত্তা ও মানবসম্পদ নীতি
শুধুমাত্র শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে প্রশাসনিক রদবদল হবে
অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কর্মস্থলে বহাল থাকবেন
নতুন নিয়োগপ্রাপ্তদের জন্য যোগ্যতা যাচাই প্রক্রিয়া থাকবে
ব্যাপকভাবে ছাঁটাই নয়, বরং পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা হবে
সম্পূর্ণ একীভূতকরণ প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে সময় লাগবে আনুমানিক তিন বছর
আর্থিক চিত্র ও চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এই পাঁচ ব্যাংকের মোট আমানতের পরিমাণ ১ লাখ ৪৬ হাজার কোটি টাকা এবং মোট ঋণ ১ লাখ ৯২ হাজার ৭৮৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৭৬ শতাংশ অর্থাৎ ১ লাখ ৪৬ হাজার ৯১৮ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ।
খেলাপি ঋণের হার:
ইউনিয়ন ব্যাংক: ৯৮%
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক: ৯৭%
গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক: ৯৫%
সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক: ৬২%
এক্সিম ব্যাংক: ৪৮.২০%
ব্যাংকগুলোর সম্মিলিত শাখা ও নেটওয়ার্ক:
৭৬০টি শাখা
৬৯৮টি উপ-শাখা
৫১১টি এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেট
৯৭৫টি এটিএম বুথ
সম্পদ উদ্ধারের কৌশল
আইনি প্রক্রিয়া
আদালতের রায় ছাড়া সম্পদ উদ্ধার সম্ভব নয়
নির্ভরযোগ্য তথ্যের ভিত্তিতে মামলা প্রস্তুত করা হচ্ছে
দেশি সম্পদের জন্য দেশের আদালতে, বিদেশি সম্পদের জন্য সংশ্লিষ্ট দেশের আদালতে মামলা হবে
বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (ADR)
আদালতের বাইরে আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তির সুযোগ রাখা হচ্ছে
সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর আইনজীবীদের মাধ্যমে সমঝোতার পথ খোঁজা হবে
কোন পথ অনুসরণ করা হবে তা নির্ধারণ করবে সরকার
অন্যান্য উদ্যোগ
বিদেশি সংস্থাগুলোর সহায়তায় পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার কাজ চলছে
অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে
৫৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, যার মধ্যে ইসলামী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আহসানুল আলম অন্যতম
ইসলামী ব্যাংকিং খাতের পুনর্গঠন
দেশে বর্তমানে ১০টি ইসলামী ব্যাংক সক্রিয়, যার মধ্যে অনেকগুলো আর্থিক সংকটে রয়েছে।
এদের একীভূত করে দুটি বড় শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক গঠন করা হবে
ইসলামী ব্যাংকিংয়ের জন্য পৃথক আইন ও নিয়ন্ত্রক কাঠামো প্রণয়নের কাজ চলছে
ইতোমধ্যে ১১টি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে পরিবর্তন আনা হয়েছে
সামগ্রিক ব্যাংকিং সংস্কার
ব্যাংক রেজ্যুলেশন অ্যাক্ট প্রণয়ন প্রক্রিয়াধীন
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন জোরদারে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে
ব্যাংকের দৈনন্দিন কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ নয়, বরং নিবিড় তদারকি চালু হবে
ব্যাংক কোম্পানি আইনে সংশোধন করা হবে, বিশেষত পরিচালকদের যোগ্যতা নির্ধারণের ক্ষেত্রে
উপসংহার
পাঁচটি দুর্বল ইসলামী ব্যাংক একীভূত করে একটি শক্তিশালী শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক গঠনের উদ্যোগ বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের জন্য এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এটি শুধু খেলাপি সংকট মোকাবিলায় নয়, বরং সার্বিক আর্থিক শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখবে। এই প্রক্রিয়া সফলভাবে বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, দক্ষ ব্যবস্থাপনা এবং অংশগ্রহণমূলক প্রয়াস।