সর্বশেষ আন্তর্জাতিক রাজনীতি অর্থনীতি দেশ ভিডিওচিত্র ২

বাংলাদেশে টানা মূল্যস্ফীতি ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে ভ্যাট আরোপ নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনযাত্রাকে চরম বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। রিকশাচালক, দিনমজুর, শিক্ষার্থী ও স্বল্প আয়ের পরিবারগুলো প্রতিদিনের বাজারে বাঁচার লড়াইয়ে হিমশিম খাচ্ছে। খাদ্যপণ্যে ভ্যাট সংযোজন এ সংকটকে আরও ঘনীভূত করেছে।


মূল্যস্ফীতি কোথায় দাঁড়িয়ে

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, ফেব্রুয়ারি ২০২৫-এ সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.৬৭ শতাংশ। এর আগের এক বছরজুড়েই এটি ৯ শতাংশের ওপরে অবস্থান করছে। খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি আরও উদ্বেগজনক—২০২৪ সালের জুনে ছিল ৯.৭৩ শতাংশ, যা মে মাসের তুলনায় বেড়েছে।

অর্থনীতিবিদরা এই মূল্যস্ফীতির পেছনে কয়েকটি বড় কারণ চিহ্নিত করেছেন:

  • রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ: জ্বালানি ও খাদ্যপণ্যের বৈশ্বিক দাম বেড়ে গেছে।

  • ডলার সংকট: আমদানি ব্যয় বেড়েছে টাকার মান কমে যাওয়ায়।

  • কর ও ভ্যাট বৃদ্ধি: নিত্যপণ্যে অতিরিক্ত করের কারণে খুচরা দামে তীব্র প্রভাব পড়ছে।


ক্ষতির প্রধান শিকার কারা

রিকশাচালক ও দিনমজুর

দিনে ৫০০–৬০০ টাকা আয়ে সংসার চালানো এখন প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে। পণ্যের দাম বাড়লেও মজুরি অপরিবর্তিত থাকায় তাদের জীবনে চাপ বেড়েছে। রাজধানীর এক রিকশাচালক বলেন, "ভাড়া তো আগের মতোই, কিন্তু চাল-তেল কেনার টাকাই থাকে না।"

শিক্ষার্থী ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবার

বিশ্ববিদ্যালয়ের মেসে খাবারের খরচ গত এক বছরে প্রায় দ্বিগুণ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী জানান, “আগে ৩ হাজার টাকায় চলত মাস, এখন ৫ হাজার টাকায়ও হচ্ছে না।”

কৃষক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী

সার, ডিজেল, কীটনাশক—সব কিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় কৃষকের উৎপাদন খরচ আকাশছোঁয়া। সেইসঙ্গে বাজারে পণ্য বিক্রির সময় সিন্ডিকেটের কারণে ন্যায্য দামও মিলছে না। ফলে কৃষক মুনাফা হারাচ্ছেন, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাও ক্ষতির মুখে।


ভ্যাটের বাড়তি বোঝা

চাল, ডাল, তেল, চিনি—এসব মৌলিক খাদ্যপণ্যে ভ্যাট আরোপের ফলে দাম আরও বেড়েছে। সরকার কিছু পণ্যে ভর্তুকি দিলেও তা খুবই সীমিত এবং সঠিকভাবে বিতরণ না হওয়ায় বাস্তব উপকার মিলছে না। কর ব্যবস্থাপনার অনিয়ম ও জবাবদিহিতার অভাবের কারণে এই করের বোঝা শেষমেশ গিয়ে পড়ছে সাধারণ ভোক্তার ওপরেই।


সমাধানের পথ

অর্থনীতি বিশ্লেষকরা সংকট নিরসনে নিম্নোক্ত কার্যকর পদক্ষেপের সুপারিশ করছেন:

  1. ভর্তুকি বাড়ানো: আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমলেও দেশের বাজারে তা প্রতিফলিত হয়নি। সরকারকে খাদ্য ও জ্বালানিতে যথাযথ ভর্তুকি দিতে হবে।

  2. বাজার নজরদারি: অসাধু সিন্ডিকেট ও মজুদদারদের নিয়ন্ত্রণে আনতে শক্তিশালী বাজার তদারকি গঠন জরুরি।

  3. সামাজিক সহায়তা সম্প্রসারণ: দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য ট্র্যাকিং-ভিত্তিক রেশন, ক্যাশ ভাউচার বা ভর্তুকি মূল্যে পণ্য সরবরাহ কার্যকর করতে হবে।

  4. স্থানীয় উৎপাদন বাড়ানো: কৃষি ও শিল্পখাতে বিনিয়োগ বাড়িয়ে উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে।


শেষ কথা

মূল্যস্ফীতি কেবল একটি পরিসংখ্যান নয়—এটি মানুষের জীবনযাত্রার মান, খাদ্য গ্রহণের সক্ষমতা ও সামাজিক স্থিতিশীলতার সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। আর ভ্যাট-নির্ভর রাজস্বনীতির নেতিবাচক প্রভাব যখন নিত্যপণ্যে পড়ে, তখন সেটা সমাজের সবচেয়ে দুর্বল শ্রেণিকে সবচেয়ে বেশি আঘাত করে।

অর্থনীতিবিদদের ভাষায়, “মূল্যস্ফীতি এখন একটি জাতীয় জরুরি বিষয়। তা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হলে আর্থসামাজিক স্থিতি বজায় রাখা কঠিন হবে।” এখন প্রয়োজন দ্রুত, সুসংহত ও বাস্তবমুখী নীতিগত সিদ্ধান্ত।


সম্পাদকীয় মন্তব্য:
এই সংকট মোকাবিলায় নীতিনির্ধারকদের উচিত হবে জনস্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে, বাজার ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া এই সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়।

আরও পড়ুন...

জনপ্রিয়

সর্বশেষ খবর