প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও ফিলিস্তিন হাতছাড়া
আম্মার হাফীজ
পটভূমি: ১৯১৪ খ্রি. থেকে ১৯১৮ খ্রি. পর্যন্ত তৎকালীন পরাশক্তিগুলোর মাঝে যে নৃশংস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল, ইতিহাসে তা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ নামে পরিচিত। ভয়াবহ এ যুদ্ধের মাধ্যমে বিশ্বমানচিত্র পাল্টে যায়। পালাবদল হয় পরাশক্তির। বদলে যায় বিশ্বঅর্থব্যবস্থা।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণ: দীর্ঘ একটা সময় পর্যন্ত পৃথিবীবাসী মনে করত ভয়াবহ এ যুদ্ধের কারণ- অস্ট্রিয়ার প্রিন্স হত্যাকান্ড। কিন্তু অনস্বীকার্য বাস্তবতা হচ্ছে- এ যুদ্ধের আসল কলকাঠি নাড়া লোকগুলো ছিল জায়নবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য সদা তৎপর ইহুদী ধনকুবের ও রাজনীতিবীদ, তারা তৎকালীন পরাশক্তিগুলোর মাঝে যুদ্ধ বাঁধিয়ে পরাশক্তিগুলোকে দূর্বল করে নিজেরা শক্তি অর্জন করতে চেয়েছিল।
যুদ্ধের সূচনা: অস্ট্রিয়ার প্রিন্স ফ্রান্স ফার্ডিন্যান্ড ১৯১৪ সালে এক সফরে জনৈক সার্বীয় আততায়ীর হাতে নিহত হয়। আকস্মিক এই হত্যাকান্ডে ক্ষুদ্ধ হয়ে ঐ বছরই জুলাই মাসে অস্ট্রিয়া সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। সার্বিয়ার মিত্রদেশ রাশিয়া সার্বিয়ার পক্ষ নেয়। সাথে যুক্ত হয় ব্রিটেন ও ফ্রান্স। অন্যদিকে অস্ট্রিয়ার পক্ষ নেয় জার্মানি। এভাবেই যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে।
উসমানী সাম্রাজ্যের অংশগ্রহণ: যুদ্ধ শুরুর এক যুগ আগ থেকেই জার্মান ও উসমানী সাম্রাজ্যের মাঝে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। তাই যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর প্রশ্ন ওঠে, উসমানী সালতানাত কি জার্মানের পক্ষ নেবে নাকি নিরপেক্ষ থাকবে? সুলতান মুহাম্মাদ রাশাদ ও অন্যান্য মন্ত্রীরা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করাকে অনর্থক ও অপ্রয়োজনীয় মনে করেন। ইতিহাস বলে- এটাই যথোপযুক্ত সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল। কিন্তু প্রতিরক্ষামন্ত্রী আনোয়ার পাশা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তার এমন চিন্তা হওয়ার কারণ ছিল প্রধাণত তার জোশ-উদ্দীপনা, দ্বিতীয়ত জার্মানদের পক্ষ থেকে উসমানী সাম্রাজ্যকে এ নিশ্চয়তা প্রদান যে, ফ্রান্স, ব্রিটেন ও রাশিয়া পদানত হলে এ সমস্ত ভূখন্ড উসমানী সাম্রাজ্যের শাসনাধীন থাকবে। এছাড়াও আনোয়ার পাশার সাহসীকতা, জাতীয় আত্মমর্যাদাবোধ ও ধর্মীয় চিন্তাবোধ তাকে উসমানী সাম্রাজকে পুণরায় মহাশক্তি হিসেবে অধিষ্ঠিত করতে স্বপ্ন দেখাতে থাকে। এ সমস্ত বিষয়ে প্রলুব্ধ হয়ে মধ্য এশিয়ার উপর আধিপত্য বিস্তার এবং মিশর ও তিউনিসিয়ার শাসন ফিরে পাবার আশায় আনোয়ার পাশা নৌমন্ত্রী জামাল পাশাকে রাশিয়ার উপর আক্রমণ করার নির্দেশ দেন। যেই কথা সেই কাজ। জামাল পাশা কৃষ্ণসাগরে অবস্থিত রাশিয়ার ওডেসা বন্দরে একটি জাহাজ ডুবিয়ে দেয়। কিন্তু মজার বিষয় হলো- রাশিয়ার যুদ্ধজাহাজ ধ্বংসের পর সুলতান জানতে পারেন যে, উসমানীয়রা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। সুলতান তখনো সমঝোতা করে যুদ্ধে থেকে বেরিয়ে আসতে পারতেন। কিন্তু পার্লামেন্টে উসমানীদের স্বভাবজাত জোশ-জযবার প্রাবল্যের কারণে একরকম বাধ্য হয়েই সুলতান যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার উপর রায় দেন। এভাবেই উসমানীয়রা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।
যুদ্ধের ফলাফল: যুদ্ধের প্রথম বছরগুলোতে উসমানী ও জার্মানিদের পাল্লা ভারী ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে উসমানীদের কিছু ভুল সিদ্ধান্ত ও বিভিন্ন সংকট তাদের এই জয়ের ধারাকে পর্যবসিত করে। এরপর একে একে তাদের রাজ্যগুলোর পতন ঘটতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯১৭ সালের ৯ ডিসেম্বর ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর হাতে বাইতুল মাকদিসে পতন হয়। অবশেষে ১৯১৮ সালে জার্মান ও উসমানী সাম্রাজ্যের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে এই রক্তক্ষয়ী নৃসংশ যুদ্ধের অবসান ঘটে।
ফিলিস্তিনে ইহুদীদের অনুপ্রবেশ: বিংশ শতাব্দীর শুরুর কথা। ফিলিস্তিন তখন উসমানী খেলাফতের শাসনাধীন একটি সুন্দর, আকর্ষণীয় ও সমৃদ্ধ প্রদেশ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইহুদীদের তখন বিক্ষিপ্ত বসবাস। তাদের ছিল না কোনো নিজস্ব আবাসভূমি। ছিল না কোনো স্বতন্ত্র ইহুদী রাষ্ট্র। সাংবাদিক থিওডর হার্টজেল সর্বপ্রথম ইহুদীদের মাঝে স্বাধীনতার প্রেরণা সৃষ্টি করে। ইহুদীদের জন্য স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য হার্টজেন ও অন্যান্যদের দৃষ্টি পড়ে ফিলিস্তিনের নয়নাভিরাম শ্যামল ভূমির প্রতি। তাই ইহুদীরা ব্রিটেনের রাজার সাথে এই মর্মে চুক্তি করে যে, যদি ব্রিটেন তাদের প্রতিশ্রুত ভূমিতে তাদের জন্য একটি রাষ্ট্র গঠন করে দেয়, তাহলে তারা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটেনের সমস্ত ব্যয় পরিশোধ করে দিবে। এই চুক্তিটি হয় ১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর।
এ উপলক্ষে ব্রিটেনের তৎকালিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্যালফোর যে ঘোষণা দেয় ইতিহাসে তা "ব্যালফোর ঘোষণা" নামে পরিচিত, এ ঘোষণার মধ্য দিয়েই ফিলিস্তিনে ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও ইহুদীদের পৃথক আবাসভূমি স্থাপনের পথ সুগম হয়।
১৯৩১ সালে ফিলিস্তিনে ইহুদীদের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় পৌনে দুই লাখে, যা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ছিল কয়েক হাজার। ইতিমধ্যে জার্মানীতে হিটলারের ইহুদী নিধন শুরু হয়। ইহুদীরা তখন জার্মান থেকে ফিলিস্তিনে দলে দলে আসতে থাকে। ১৯৩২ সাল থেকে ১৯৩৫ পর্যন্ত ফিলিস্তিনে ইহুদী আগমনের সংখ্যা বার্ষিক নয় হাজার থেকে ষাট হাজারে উন্নীত হয়। ১৯৪৭ সালের ২৯ নভেম্বর জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে আরব ও ইহুদী রাষ্ট্রে বিভক্ত করার এক ঘৃণ্য প্রস্তাব পেশ করে। প্রস্তাব অনুযায়ী ফিলিস্তিনের ৮ ভাগ ইহুদী- যাদের ৯০% ই বহিরাগত– তারা পায় ৫৬ শতাংশ এলাকা আর ৯২ ভাগ মুসলিম অধিবাসীরা পায় ৪৪ শতাংশ এলাকা। ঐতিহাসিক এই অবিচার কর্ম সম্পাদন সম্ভব হয়েছে কেবল বৃহৎ চতুঃশক্তির ইহুদী সখ্যতার ফলেই। অবশেষে ১৯৪৮ সালের ১৪ মে মধ্যরাতে ইহুদীরা তেলআবিবকে রাজধানী করে স্বাধীন ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়। সর্বপ্রথম ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয় আমেরিকা। পরবর্তীতে সোভিয়েত, ইউনিয়ত, ব্রিটেন ও ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশ ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়। এভাবেই অবৈধ দখলদাররা "মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোঁড়া" নামধারণ করে ফিলিস্তিনে তাদের অবস্থান দৃঢ় করে নেয়।
শেষ কথা: আজ মুসলমানরা নির্যাতিত। গাজা, কাশ্মীর, আরাকান, উইঘুর- পৃথিবীর নানা প্রান্তে তারা আজ অবহেলিত, নিপীড়িত। তাদের বেঁচে থাকার অধিকার নেই। নেই ধর্মপালনের অধিকার। পৃথিবীর তাবৎ কুফুরীশক্তি একাট্টা হয়ে মুসলিম নিধনে নেমেছে অথচ মুসলমানদের এমন সঙ্গিন মুহুর্তেও আমরা উদাসীন। অপর ভাইয়ের আর্তনাদ, হাহাকার ও ধ্বংসের নিরব দর্শক। ইতিহাস বলে, দীর্ঘ সময় পর্যন্ত পৃথিবীর শাসন ক্ষমতা আমাদের হাতেই ছিল। আমরাই ছিলাম পৃথিবীর পরাশক্তি। কিন্তু যেই আমরা ভোগ-বিলাসে মত্ত হয়ে পড়লাম তখন থেকেই শুরু হলো পতনের অব্যাহত ধারা। আমরা হয়ে পড়লাম বিজাতীদের আজ্ঞাবহ দাস।
হে মুসলিম যুবক, তোমাকেই বলছি– প্রস্তুত হও, মুসলমানদের ভাগ্যাকাশকে সুপ্রসন্ন করতে স্বপ্ন বুনো, চেষ্টা কর এবং সফল হও পরম করুণাময় আল্লাহর সাহায্যে!
-ফযীলত
জামিয়াতুল উলূমিল ইসলামিয়া ঢাকা
0 মন্তব্য রয়েছে