শিক্ষানীতির অনুপম ভাবনা

সময়টা খুবই নাজুক। পরিবেশটা পারাজয় আর অধঃপতনের অন্ধকারে আচ্ছাদিত। মানবতা চরম সংকটে পতিত। বস্তুবাদিত্বের একচ্ছ আগ্রাসনে পুরো জাহান নিপীড়িত। চারদিকে পশ্চিমাদের জয়গান। অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজনীতি ও কুটনীতিতে ওদের সরগরম অবস্থা। হালযমানায় সভ্যতা-সংস্কৃতি মানেই যেন পশ্চিমা সভ্যতা। তাদের রাজনৈতিক বয়ানই বর্তমানে সকল রাজনীতির উৎস। লাইফস্টাইলে রয়েছে তাদের এক নিরব আগ্রাসন। মানবতার দেয়াল তাদের মিথ্যা প্রোপাগান্ডায় জর্জরিত। তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক ও নিরব সাংস্কৃতিক আগ্রাসন মানুষের চেতনাকেই পাল্টে দিয়েছে। মুসলিমরাও এর থাবা থেকে বাঁচতে পারেনি। মুসলিমরা তাদের চিন্তা-চেতনায় প্রভাবিত তো হয়েছেই বরং নিজের সুস্থ চিন্তা-চেতনা ও সংস্কৃতি নিয়ে হীনমন্যতার শিকারও হয়েছে। এতটাই হীনমন্য হয়েছে যে, ইসলামের যেটাই পশ্চিমা-সভ্যতার সাংঘর্ষিক সেটাকেই তারা পশ্চিম চেতনার আলোকে ব্যাখ্যা করার সর্বাত্বক চেষ্টা করেছে। মুসলিম সমাজের শিক্ষা-সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও ব্যবসা-বানিজ্য সবকিছুই হাল যমানায় তাদের আদলে তৈরি। বিশেষত উপমহাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা তো একেবারেই ভঙ্গুরাপূর্ণ। ব্রিটিশ উপনিবেশী সাম্রাজ্য তো ভারতবর্ষের শিক্ষাধারণাকে পাল্টে দিয়েছিল বরং মুসলিম শিক্ষা ব্যবস্থাকে একেবারে নাস্তানাবুদ করে দিয়েছিল। তো পৃথিবীজুড়েই পশ্চিমাদের আগ্রাসী মনোভাব ও সাম্রাজ্যবাদী চেতনা একাটা বিরাট আঘাত হেনেছে। মুসলিমরা ওহীর শিক্ষাকে পিছনে ফেলে তাদের পিছনেই ছুটছে। এমন কোন সেক্টর নেই যেখানে পশ্চিমা-চিন্তার প্রভাব নেই। শিক্ষা-দীক্ষা, শক্তি-প্রশিক্ষণ, জ্ঞান-বিজ্ঞান, ব্যবসা-বানিজ্য, সমরজ্ঞান, সমরাস্ত্র সব কিছুতেই মুসলিমরা তাদের প্রভাবে প্রভাবিত। তাদের দেখানো পথে পরিচালিত। নীতি-নৈতিকতার অদলবদল মুসলিমদেরকে পশুত্বের জীবনে ঠেলে দিয়েছে। নাম নেহাৎ মুসলিম শাসকরা আজ এতটাই অকেজো ও হীনবল যে, বর্তমান ফিলিস্তিন ট্রাজেডি নিয়ে কথা বলতে তাদের পশ্চিমা প্রশুদের অনুমতি নিতে হয়। মহান প্রভুর গোলামি ছেড়ে তারা পশ্চিমা পশুদের গোলামিতে এতটাই নিমজ্জিত যে, এর মাশুল জাতিকে শতাব্দী যাবত বহন করতে হচ্ছে। পৃথিবীর এমন কোন জায়গা বাকী আছে যেখানে মুসলিমরা নির্যাতিত নিপীড়িত নয়। জুলুমের শিকলে আবদ্ধ নয়। সর্বত্রই পশ্চিমাদের জয়গান আর চিন্তা-চেতনার একচেটিয়া রাজত্ব। তবে হ্যাঁ, পশ্চিমাদের এই রাজত্বের পিছনে তাদের অনেক কিছুরই অবদান আছে। সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করেছে তাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও চিন্তা-চেতনার পরিশীলন।

তারা তাদের চিন্তা-চেতনা বিকাশে ও শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে আকাশচুম্বী চেষ্টা করেছে। আর পৃথিবীর এক সাধারণ নীতি যে, যে চেষ্টা করবে সে সফলতা কিছুটা হলেও পাবে। তাদের অক্লান্ত পরিশ্রম, আহ্বান, চেষ্টা ও পূর্ণ অধ্যবসাই তাদেরকে এ পর্যন্ত নিয়ে গেছে। তারা চেয়েছে তাদের চিন্তা দিয়ে চিন্তা করুক, তাদের চেতনায় উজ্জীবিত হোক, তার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টাও তারা করেছে। তাই তার ফল এখন তারা পাচ্ছে।

আর যে জাতি সঠিক জ্ঞান-বুদ্ধি ও চেতনাবোধ থেকে মুক্ত তার জন্য এর চেয়ে বিপদজনক আর কিছুই হতে পারে না। যে জাতি গভীর চিন্তা-ভাবনায় দুর্বল সে আস্থার যোগ্য নয়। বরং সে জাতিই না। যতদিন পর্যন্ত মুসলিম বিশ্ব জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, রাজনীতি, সমরনীতি, অর্থনীতি, শিল্প ও ব্যবসা-বানিজ্যে পশ্চিমাদের গোলামী করবে কতদিন পর্যন্ত তারা লোহার শিকলে আবদ্ধই থাকবে। সফলতার মুখ দেখতে পারবে না। বরং সফলতার কথা ভাবতেই পারবে না। তাই সাধারণ শিক্ষা ও জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রচার চেতনাবোধ জাগ্রত করা ও শক্তি-প্রশিক্ষণ, জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-প্রযুক্তি, ব্যবসা-বানিজ্য ও সময় শাস্ত্রে পূর্ণ প্রস্তুতি ও শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো হাল-যমানায় মুসলিম বিশ্বের জন্য অতীব জরুরি কাজ।

এমন শিক্ষা পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে যা থেকে শিশুবাচ্চাসহ যে কোনো বয়সের কিশোর-যুবক, তরুণ-তরুণী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সকলেই জ্ঞানের আলো পাবে। আর প্রত্যেকের জ্ঞানের আলোটা হবে তার প্রতিভার আলোর সমন্বয়ে। দ্বীনের মৌলিক শিক্ষা সব শ্রেনির জন্য অপরিহার্য এটা বলার অপেক্ষা রাখে না তবে সকলকে এক বিষয়ে পারদর্শী হতে হবে এটা জরুরি না। প্রাচীন পৃথিবীর উপর মুসলিম বিশ্বের জ্ঞানগত কার্যকরি প্রভাব ছিল। শতাব্দীর পর শতাব্দী সভ্যদুনিয়া তার বুদ্ধি দিয়ে ভেবেছে। তার কলম দিয়ে লিখেছে। পৃথিবীর সভ্যতা-সংস্কৃতি তার সভ্যতার অস্থি মজ্জায় মিশে গিয়েছিল। বরং পৃথিবীবাসীকে সভ্যতা শিখিয়েছেই মুমিন-বিশ্বাসীরা। জ্ঞানীগুণীজন গুরুত্বপূর্ণ বই লিখতে চাইলে আরবীতেই লিখতেন। আলী ইবনে সীনার কিতাবুত তীব্ব তো চিকিৎসাশাস্ত্রের ভিত্তিকে পূর্ণ মজবুত করে দিয়েছিল। সময়ের চাহিদা পূরণে তার ছিল কার্যকরি ভূমিকা। মধ্যযুগে ১২ শতাব্দীতে ইউরোপের শিক্ষা ব্যবস্থায় মুসলিম শিক্ষা বেশ প্রভাবী ছিল। এরপর ইউরোপের উন্নতি ও উত্থান এবং যুগের চাহিদা পুরণে যথা শিক্ষানীতি প্রণয়ণ অন্যসব কিছুকে বানের পানিতে ভাসিয়ে নিজেই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রইল। এর সক্ষমতা এতটাই প্রভাবী হলো যে, মুসলিম বিশ্ব এর সামনে আপাদমস্তক হতে বাধ্য হলো। দ্বীনের মৌলিক শিক্ষা সব সময়ই অপরিবর্তিত ছিল, আছে, থাকবে ইনশাআল্লাহ। এর বাহিরে অন্য সবকিছুই পরিবর্তনশীল। একাটা বিষয় সবসময় সবযুগের জন্য উপযোগী নাও হতে পারে। এবং হয়ও না। বরং যুগের পরিবর্তনের সাথে মানুষের মেধা-মনন, চিন্তা-চেতনা সবকিছুই পরিবর্তনশীল। তাই শিক্ষার কোনো ধারাকে সবযুগের জন্য নির্ধারিত মনে না করে যুগের চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন যুগের অন্যতম একাটা দাবি। হাল-যমানায় তো এর গুরুত্ব অপরিসীম। এহেন সময়ে মুসলিম সমাজে প্রচলিত কোনো শিক্ষা ব্যবস্থাই যথেষ্ট নয়। না আছে বাচ্চাদের সুন্দর চিন্তা-চেতনা ও আদব-কায়দা শিখানোর ব্যবস্থা। না আছে যুবতী, কিশোর-কিশোরীদের প্রতিভার মূল্যায়ন।

বরং সীমাবদ্ধতার অন্ধকার সবকিছুকেই খেয়ে ফেলেছে। আর কওমি শিক্ষাব্যবস্থা যদিও একটি সাড়া-জাগানো শিক্ষাধারা এবং দ্বীনি খেদমতে যার অবদান অতুলনীয় তাও যুগের চাহিদা পূরণে পুরো অংশে যথেষ্ট নয়। তবে এটি আপদকালীন শিক্ষাব্যবস্থা, সুস্থ পরিকল্পনার সাথে এর পূর্ণ সংস্কার বর্তমান যুগের অন্যতম চাহিদা। তবে যতদিন পর্যন্ত ইসলামী হুকুমত কায়েম না হচ্ছে ততদিন এ ব্যবস্থাকে জিয়িয়ে রেখে ইসলামী মৌলিক শিক্ষাকে প্রাণবন্ত রাখতে হবে। তবে হ্যাঁ, কওমি শিক্ষা ধারাও ব্যাপক চিন্তামূলক পরিবর্তনের মাধ্যমে যুগের চাহিদা মিটাতে পারে। যা আকাবির আসলাফের চিন্তা-চেতনার বিপরীত কিছু নয়। মুসলিম বিশ্ব গোলামি ছেড়ে বিশ্বের নেতৃত্ব লাভ করতে চাইলে তাকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের নেতৃত্ব দিতে হবে। তার শিক্ষা সিলেবাস কুরআন, হাদীস, ইতিহাস, আইন, ঔষধ, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, ভাষা ও ভাষাতত্ত্ব, ভূগোল, প্রযুক্তি, শিল্পকলা সমৃদ্ধ হতে হবে। ৯৮৯ সালে তিমবুকতু নামক স্থানে স্যানকোরা মসজিদকে কেন্দ্র করে বিচারপতি আল-কাদি ইবনে মাহমুদ ইবনে উমর একটি জামিয়া গড়ে তুলেন। সেখানে উপরোক্ত বিষয়গুলো যত্নের সাথে পাঠদান হতো। বিস্ময়ের বিষয় কী সেখানে চাষাবাদ, মৎস্য চাষ, পাদুকা নির্মাণ বিদ্যা, ভবন নির্মাণ বিদ্যা ও দিক নির্ণয় বিদ্যাও শেখানো হতো। যা তৎসময়ে যুগের চাহিদা মেটাতে যথেষ্ট অবদান রেখেছে। তাই প্রয়োজন ব্যাপকভাবে বই পুস্তক রচনা করা। জ্ঞান-বিজ্ঞানে নতুনভাবে কাজ শুরু করা। এক্ষেত্রে নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তিদের সমকালীন জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পর্কে যথেষ্ট জানা-শোনা ও গভীর ধারণা থাকতে হবে। এর পরিপূর্ণতা কোনো সংগঠন বা দলের পক্ষে একটু কঠিন তবে সম্ভব। তবে চেতনার বিস্তৃতি ঘটানো তো কারো পক্ষেই অসম্ভব না। সকলেই পারবে সঠিক চিন্তাকে সকলের দ্বারে দ্বারে পৌঁছে দিতে। আর ইসলামী হুকুমত হলে তো কোনো কথাই নেই। তার জন্য এসব বাস্তবায়ন একেবারেই পানির মতো সহজ। এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের সর্বাগ্রে এগিয়ে আসতে হবে। তাদের মাধ্যমেই এমন সিলেবাস তৈরি সম্ভব যা একদিকে কুরআন-সুন্নাহর অটুট বিধান সংবলিত, অপরদিকে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির পরিবেষ্টনকারী। আর এসবই সম্ভব সঠিক চেতনাবোধ, বিরাট কুরবানি এবং প্রাণান্তকর সাধনার মাধ্যমে।

আল্লাহ মুসলিম জাতিকে জাগিয়ে তুলুন সঠিক পথ দেখান। আমীন।

আরও পড়ুন...

0 মন্তব্য রয়েছে

একটি মন্তব্য করুন

চিন্তা করবেন না! আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশ করা হবে না।

জনপ্রিয় ব্লগ

বিভাগ

সর্বশেষ ব্লগ