মানব ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তি হযরত মুহাম্মাদ

মনুষ্যত্ববোধ লালন করা আমাদের জীবনের অপরিহার্য অংশ। মননগুণটির উপস্থিতির ফলে পারস্পরিক সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি, মায়া-মমতা, বিপদকালীন নিঃস্বার্থ সহযোগিতা, এবং উৎসাহবর্ধক প্রত্যাশায় মানব জীবন ভরপুর। মানবতা শুধু চারটি অক্ষর দিয়ে মোড়ানো একটি শব্দ নয়। মানবতা হচ্ছে ধর্ম-বর্ণের ভেদাভেদ উপেক্ষা করে একতাবদ্ধ হওয়ার অনুপম মানসিক শক্তি, মেহনতের উপকাঙ্ক্ষা, সাম্য প্রতিষ্ঠার সামষ্টিক প্রয়াস।

প্রায় সাড়ে চৌদ্দশত বছর পূর্বে পৃথিবীতে নেমে এসেছিল জুলুম-নির্যাতনের এক অমাবশ্যার রাত। এক আলোকবর্তিকার আগমন পর্যন্ত পৃথিবীতে ইনসাফের সূর্যদয় হয়নি। গোত্র ভিত্তিক যুদ্ধের দামামায় আসমান-জমিন প্রকম্পিত। চারিদিকে হাহাকার। আজ যা নারীর ধন জীবন্ত কন্যা কবর দেওয়া নির্দয় বাবার আত্মগর্বের খোরাক। নিষ্পাপ শিশুর মায়াবী চাহনিতে গলত না মুশরিকদের নিষ্ঠুর মন। মানবসত্তা বিকাশের রূপকার মা' জাতি ছিল অবহেলার শিকার, প্রবৃত্তির চাহিদা চরিতার্থ করার ভোগ্যসামগ্রী মাত্র। ডাকাতি, খুন, লুটতরাজ ছিল বীরত্বগাঁথা কাব্যচর্চার উৎস। পুরো পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ তায়ালাকে ভুলে মূর্খতার অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল মানবসমাজ। অর্থাৎ মানবতা যখন মৃতপ্রায়, তখন মানবতার কেতন নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন আদর্শ ও সভ্যতার অনন্য পাঠশালা হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।

মানব ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তি হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর চরিত্র মাধুরী দিয়ে আইয়ামে জাহিলীয়্যাতের রূপকে রূপান্তরিত করেছিলেন শ্রেষ্ঠরূপে। মানবতার গুরুত্ব, তড়িৎ বাস্তবায়ন, সর্বত্র কায়েমের প্রয়োজনীয়তা ইত্যাদি সবকিছু সম্পর্কে আরব মুশরিকরা ছিল চরম অন্ধ। শানিত তরবারির ঝংকার, অগ্নি দৃষ্টি, এবং নগ্ন হত্যার পাশবিকতা ছিল নবিজীর আবির্ভাব পূর্ব মানুষের নিত্যসঙ্গী। কিন্তু এই মানুষগুলোই প্রিয় নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সমূহ দাওয়াতকে কবুল করল। একটি ঐশী দোয়া শ্রবণ করা হলো— রাযিয়াল্লাহু আনহুম (আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট)। আইয়ামে জাহিলিয়্যাতকে স্বর্ণযুগ বদলে দিলেন।

মানবতার সমূহ দিক মহানবী হয়রত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ সীরাতে বিদ্যমান আছে, তিনি মানবতার এমন ধারক ছিলেন, মক্কার বর্বর মুশরিকরাও তাকে উপাধি দিয়েছিল "আল আমীন" (একজন বিশ্বস্ত অস্থাভাজন ব্যক্তি)। তাঁর মানবীয় আচরণের সম্মিলন পৃথিবীস্থ সব জীব-জন্তুর সাথে ঘটেছে। তিনি বুঝতে পারতেন তাবলা পশু-পাখির আবেদন। তাদেরকে কষ্ট দেওয়া হলে তিনি বারণ করতেন। যুদ্ধের ময়দানে নিহত সৈনিকদের সাথে পাশবিক আচরণ কখনো সহ্য করতেন না। অসুস্থ ব্যক্তিদের সেবা, তাদের সার্বিক সমস্যা উত্তরণের প্রতি খেয়াল করা ছিল তার প্রধানতম কাজ। তার প্রতিটি দ্ব্যর্থহীন বাণী মানবাতার প্রকৃত রূপ বিশ্ববাসীর সামনে উপস্থাপন করেছে। বস্তুত তিনি ছিলেন বিশ্বজগতের জন্যে রহমত।

অধুনা মানবতা বা মানবাধিকারকে খুব সংর্কীণরূপে দেখা হয়। কোনো অঞ্চলের অধিবাসীরা প্রাকৃতিক দূর্যগের মুখামুখী হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হলেই মানবতার গুঞ্জন ওঠে। মানবতার প্রয়োগ-বিকাশ যেন বিপদাপদের সাথে বিশেষায়িত। অথচ মানবজাতির সর্দার হয়রত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানবতাকে সর্বত্র কায়েমের জন্যে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করেছেন। মানবতা এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে শত্রুর প্রাণঘাতী আক্রমনকেও পরোয়া করেননি। একটি জীবন উপমা পেশ করি— নবুওয়াতের তেরোতম বছর। মুহাম্মদের ধর্মের

জয়জয়কার অবস্থা দেখে মক্কার মুশরিকরা বিক্ষুদ্ধ। সবাই পণ করল, মুহাম্মাদের ধর্মকে আর এগুতে দেওয়া যাবে না।

বি. দ্র. দুই লাইন লিখা বাদ পড়েছে।

প্রত্যেক গোত্র থেকে একজন দুর্ধর্ষ সৈনিক নিয়ে ঘেরাও করা হলো মুহাম্মদের ঘরকে। এ থেকেই হিজরতের প্রেক্ষাপট শুরু।

আলীকে তার জায়গায় শুইয়ে এবং শত্রুদের আমানত বুঝিয়ে রওয়ানা হলেন মদীনার পথে।

কেয়ামত পর্যন্ত আগত সম্প্রদায়কে বুঝিয়ে দিলেন মানবতার প্রয়োগ ক্ষেত্র। নিজের প্রাণাঘাতকে উপেক্ষা করে তাদের আমানতের রক্ষায় সচেতন ছিলেন, যারা এসেছে তাকে হত্যা করতে। মানবতার কী সুন্দর প্রয়োগ!

মানবতার গর্ব হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসালাম কেবল মানবতা কায়েম করেননি, তার পরলোক গমনের পরও যেন মানবতা পৃথিবীতে ঠিকে থাকে এইজন্যে রেখে গেছেন শ্রেষ্ঠ জানেশীন। যাদের পরিচয় দেওয়া হয় নবীর সাহাবা দিয়ে। বিশেষত খুলাফায়ে রাশেদীন হযরত আবু বকর, উমর ফারুক, উসমান গণী এবং আলী রাযিয়াল্লাহু আনহুম। তাঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন নবী সাল্লাহ আলাইহি ওয়া সালামের প্রতিচ্ছবি। খোদাভীরুতা, নিষ্ঠা, ইনসাফ, সমঝোতা, মনীষা, নেতৃত্ব, দূরদর্শিতা এবং রণকৌশলে ছিলেন একজন আদর্শবান পুরুষ। পৃথিবীর সামনে পেশ করেছেন মানবতার সমুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

ক্ষমতার বড়াই না দেখিয়ে সর্বসাধারণের খেদমতে বিলিয়ে দিয়েছেন নিজেদেরকে। প্রজাদের খোঁজখবর নেওয়ার জন্যে ধারণ করতেন ছদ্মবেশ। এই জন্যে তাদের পদচুম্বন করেছে রাষ্ট্রসম্প্রসারণ, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং সামরিক বিজয়।

মানবতার আসল রূপ জগৎবাসীর সামনে পেশ করার ফলে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার কাছেই হয়েছেন প্রাতঃস্মরণীয় এবং অনুসৃত ব্যক্তিত্ব। ভারত উপমহাদেশের রাজনীতিতে মাহাত্মা গান্ধীর মন্ত্রীদের প্রতি তার নির্দেশনা ছিল রাষ্ট্র পরিচালনার ভিত্তি হবে আবু বকর এবং ওমরের আদর্শিক রূপরেখা।

মানবতার মুখরোচক স্লোগান সর্বব্যাপী না হওয়ায় রাষ্ট্র-সমাজব্যবস্থা সবকিছু হয়ে পড়েছে ভঙ্গুর। পশ্চিমার নাকাল সভ্যতা কোনোদিনও মানবাধিকারের পক্ষে কথা বলেনি। ফিলিস্তিন, গাজা এক দ্বেদীপ্যমান উদাহরণ। সমকালীন পৃথিবীর অস্থিতিশীলতা দূরকরণের জন্য আবু বাকরী, এবং ওমরী আদর্শের বড্ড প্রয়োজন। কবি ফররুখ তাঁর কাব্যের উপাদান পেয়েছেন ওমরী আদর্শকে। তিনি বলেন,

আজকে উমরপন্থী পথীর

দিকে দিকে প্রয়োজন

পিঠে বোঝা নিয়ে পাড়ি দিবে যারা

প্রান্তর প্রাণপণ

উষর রাতের অনাবাদী মাঠে

ফসল ফলায় যারা

দিক-দিগন্তে তাদের খুঁজিয়া

ফিরিছে সর্বহারা

আরও পড়ুন...

0 মন্তব্য রয়েছে

একটি মন্তব্য করুন

চিন্তা করবেন না! আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশ করা হবে না।

জনপ্রিয় ব্লগ

বিভাগ

সর্বশেষ ব্লগ