হিজবুত তাওহীদ স্বরূপ সন্ধান
মুহা শাহেদ হাসান সা'দ
শিক্ষার্থী- জামিয়াতুল উলূমিল ইসলামিয়া ঢাকা, স্থায়ী ঠিকানা: সিরাজগঞ্জ
বিঃ দ্রঃ এই নিবন্ধের কথাগুলো কেবলই লেখকের নিজস্ব মতের প্রতিফলন করে। এর কোনো উক্তি স্বাধীনতার বার্তার স্বাধীন চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক মনে হলে আমাদের জানান। লেখাটি দ্রুত অপসারণ করা হবে।
সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়াগুলোতে ‘হিজবুত তাওহীদ’ নামক একটি সংগঠনের ব্যাপক প্রচারণা পরিলক্ষিত হচ্ছে। ধর্মীয় বিভিন্ন বিষয়ে তারা বিভ্রান্তিমূলক ও কুফরি কথাবার্তা প্রচার করছে। যদ্দরুণ অনেক সরলমনা মুসলমান তাদের চটকদার কথার ফাঁদে পড়ে ঈমান হারাতে বসেছে। তাই জনসম্মুখে তাদের পরিচয় উদঘাটন ও স্বরূপ উন্মোচন করা এখন সময়ের দাবি।
হিজবুত তাওহীদ প্রতিষ্ঠা ও উৎস:
দলটির প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ বায়েজিদ খান পন্নি, পেশায় একজন হোমিওপ্যাথি ডাক্তার। কুরআন হাদিসের ভাষা সম্পর্কে যিনি ছিলেন বাস্তবিক অর্থেই নিরক্ষর। তবে লক্ষণীয় বিষয় হল, পন্নি সাহেব তার সমস্ত চিন্তা-চেতনা গ্রহণ করেছেন কলকাতার তৎকালীন আন্দোলন ‘তেহরিক-এ-খাকসার’ এর প্রতিষ্ঠাতা এনায়েতুল্লাহ খান মাশরেকীর কাছ থেকে। যার ভ্রান্ত চিন্তাধারার ব্যাপারে তৎকালীন ওলামায়ে কেরাম সকলেই কুফরের ফতোয়া দিয়েছিলেন। ১৯৪৭ এর পর খাকসার আন্দোলন বিলুপ্ত করা হলেও পন্নী সাহেব সে চিন্তাগুলোকে নতুনভাবে ঢেলে সাজান। যা পরবর্তীকালে আরো ডালপালা ছড়িয়ে ১৯৯৫ সনে ‘হিজবুত তাওহীদ’ নামে আত্মপ্রকাশ করে। ২০১২ সালে মোহাম্মদ বায়েজিদ খান পন্নির মৃত্যুর পর নোয়াখালী জেলার হোসাইন মোহাম্মদ সেলিম সংগঠনটির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। হিজবুত তাওহীদ-এর মৌলিক কিছু কুফরি মতবাদ: তাদের সবচেয়ে মারাত্মক কুফরি চিন্তাগুলো সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরা হলো।
১. সব ধর্মই সত্য এবং যেকোনো ধর্ম পালনে রয়েছে কাঙ্ক্ষিত মুক্তি:
তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ‘মানব সমাজে ধর্ম-অধর্ম ও শান্তি-অশান্তির চিরন্তন দ্বন্দ্ব’ শিরোনামের একটি প্রবন্ধে বলা হয়েছে প্রকৃত সত্য হলো, স্রষ্টা প্রদত্ত সকল ধর্মই সত্যধর্ম। এগুলোর মাঝে কোন পার্থক্য নেই। যেকোনোটি মানুষ মেনে চলতে পারে।
২. ইসলামকে বিকৃত আখ্যায়িত করা:
তাদের ভাষ্য মতে, যুগ পরম্পরায় চলে আসা এই ইসলাম আল্লাহ রাসূলের ইসলাম নয়, এটি প্রকৃত ইসলামের সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী একটি ধর্ম বিশ্বাস। পন্নী সাহেব তার এই কুফরি মতবাদ প্রতিষ্ঠা করতে ‘এ ইসলাম ইসলামই নয়’ নামে ৪০০ পৃষ্ঠার একটি স্বতন্ত্র বই লিখেছেন। উক্ত বইয়ের ৪০-৪১ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, যেসব বিকৃতি আসার ফলে পূর্ববর্তী অন্যান্য ধর্ম বাতিল করে আল্লাহ নতুন নবী পাঠিয়েছেন সেসব বিকৃতি এই শেষ ধর্মেও এসে গেছে।
৩. পৃথিবীর সকল মুসলমানকে কাফের মনে করা, এবং অভিশপ্ত ও লাঞ্ছিত বলে গালাগালি করা:
তাদের ‘ইসলামের প্রকৃত রূপরেখা’ নামক পুস্তিকার ১৩ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, "এই জাতি এখন আল্লাহর লা'নতের ও গজবের বস্তু, এর অবস্থা এখন অতীতের অভিশপ্ত ইহুদী জাতির চেয়েও নিকৃষ্ট"।
৪. নামাজ, রোজা, হজ্জ ও যাকাত ইত্যাদি মৌলিক ইবাদতগুলোতে বিকৃত সাধন এবং এগুলোকে ইবাদত হওয়ার অস্বীকৃতি জ্ঞাপন:
"মহা সত্যের আহ্বান" সংকলনটির ৯ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, "ইবাদত হচ্ছে আল্লাহর খিলাফত করা। কিন্তু ভুল করে নামাজ, রোজা, হজ্জ, যাকাত ইত্যাদিকে ইবাদত বলে মনে করা হচ্ছে"। একই সংকলনের ১০৪ পৃষ্ঠায় আরো বলা হয়েছে, আমাদের বুঝতে হবে যে, নামাজ, রোজা, উপবাস, উপাসনা, পূজা অর্চনা ধর্মের মূল কাজ নয়।
৫. রাসূল কর্তৃক স্বীকৃত সুন্নাহ কে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা:
তাদের রচনা "ইসলাম কেন আবেদন হারাচ্ছে?" নামক বইয়ের ৬১ পৃষ্ঠায় লেখা আছে, আজ যে ইসলাম চলছে তা যে মুসলিম উৎপাদন করে তাদের আকিদা হল এই যে... রাসূলকে পাঠানো হয়েছিল মানুষকে টাখনুর উপর পাজামা পরার মত, মাথায় টুপি দেওয়ার মত, দাঁড়ি রাখার মত, দাঁত মাজার মত, কুলুখ নেওয়ার মত, ডান পাশে শোয়ার মত তুচ্ছ ব্যাপার শিখাতে।
৬. বিভিন্ন হারাম বিষয়াদির সমর্থন ও বৈধতা দান করা:
কুরআন হাদিসে সুস্পষ্ট হারাম এমন অনেক বিষয়কে তারা বৈধ মনে করে। বিভিন্ন কবিরা গুনাহের প্রতি শিথিলতা প্রদর্শন করে, নাচ, গান, নাটক, উৎসব শুধু জায়েজ নয় ক্ষেত্রবিশেষ ইবাদত গণ্য করে। এমনিভাবে তারা নারীদের পর্দাহীনতাকে সমর্থন করে ইসলামের পর্দার বিধানকে কটাক্ষ ও বিদ্রূপ করতেও ছাড়ে না। "প্রিয় দেশবাসী” নামক একটি বইয়ের ১২৭ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে, গান, নৃত্য, চিত্রকলা, সাহিত্য, নাটক ইত্যাদি শিল্পচর্চা মানবজাতির কল্যাণে সহায়ক হবে... সেগুলো কেবল বৈধ নয় আমরা মনে করি সেগুলো ইবাদততুল্য। এমনিভাবে "মহা সত্যের আহ্বান সংকলনটির ৯৪ পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে, নবান্ন উৎসব, পহেলা বৈশাখ ইত্যাদি কোন উৎসবই শরীয়ত পরিপন্থী হতে পারে না।
৭. মু'জিযার দাবি ও আল্লাহর উপর মিথ্যারোপ:
পন্নী সাহেব ২০০৮ সালে কিছু বানোয়াট ঘটনার প্রেক্ষিতে নিজের জন্য মু'জিযার দাবি করে বসেন। এ মু'জিযা সম্পর্কে তিনি বলেছেন, এর চেয়ে বড় রহমত আর কী হতে পারে? যে মু'জেযা তিনি নবীদের মাধ্যমে ঘটাতেন একটা একটা করে, এখন তিনি নিজে একসাথে আটটা মু'জেযা ১০ মিনিটের মধ্যে ঘটিয়ে দিলেন। (আল্লাহর মু'জিযা ও হিজবুত তাওহীদের বিজয় ঘোষণা-৬৮) পন্নী সাহেব শুধু এতোটুকুতে ক্ষ্যান্ত থাকেননি বরং আরো আগে বেড়ে সরাসরি আল্লাহর উপর মিথ্যারোপ করে বলেছেন- সেদিন আল্লাহ তিনটা জিনিস স্বাক্ষর করলেন, হিজবুত তাওহীদ হক, ইমাম হক, হিজবুত তাওহীদ দিয়ে সত্য দিন প্রতিষ্ঠিত হবে। (আল্লাহর মু'জিযা ও হিজবুত তাওহীদের বিজয় ঘোষণা-৬৬)
এভাবে একের পর এক হিজবুত তাওহীদের লোকেরা যেন কুফর ও ভ্রান্তির পসরা সাজিয়ে বসেছে। ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ খুব কম বিষয়ই এমন আছে যেগুলোতে তারা কোন ধরনের বিকৃতি বা কটুবাক্য ব্যবহার করেনি। আল্লাহ তাআলা, কুরআন কারীম ও নবীদের ব্যাপারে বেয়াদবি মূলক কথাবার্তা বলা, রাসূলের শানে গোড়ামি করা, হাদিস অস্বীকার করা, ফেরেশতাদের ব্যাপারে বিকৃত আকিদা পেশ করা, সাহাবায়ে কেরাম ও সালাফে সালেহীনের সমালোচনা করা, দাজ্জাল নিয়ে বানোয়াট কথা বলা ইত্যাদি লম্বা এক ফিরিস্তি। সব একত্র করা হলে হয়তোবা নাতিদীর্ঘ একটি বই তৈরি হয়ে যাবে। হিজবুত তওহীদের কিছু অপকৌশল: এসব ভ্রান্তি ও কুফরি মতবাদ থাকা সত্ত্বেও কিছু অপকৌশলের মাধ্যমে তারা সরলমনা মুসলমানদের ধোঁকা দিয়ে থাকে। উম্মাহর রাহবার ওলামায়ে কেরাম যেহেতু তাদের এসব ভ্রান্তি ছড়ানোর পেছনে প্রধান বাধা, তাই জনমনে ওলামাদের ব্যাপারে বিদ্বেষ ছড়িয়ে দিতে তাদের ঘোর সমালোচনা করে এবং ধর্ম ব্যবসায়ী বলে গালি দেয়। এছাড়াও তারা কথার মারপ্যাচ, কুরআন হাদিসের অপব্যাখ্যা, ইতিহাস বিকৃতি ও হাদিস জাল করা ইত্যাদি আরো জঘন্য অপকৌশল এর মাধ্যমে সাধারণ মুসলমানদের ঈমান হরণের পায়তারা করছে। শেষ কথা: পরিশেষে একটি বিষয়ের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই, এ জাতীয় ভ্রান্তদলগুলো নিজেদের ভ্রান্ত ও কুফরি মতবাদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিভিন্ন সময় ভালো ভালো সামাজিক কাজ আঞ্জাম দিয়ে থাকে। যার ফলে সরলমনা মুসলমানরা ধোঁকায় পড়ে তাদের দলে যোগ দান করে। এ সমস্ত ফিতনার ব্যাপারে রাসূল স. অনেক আগেই আমাদেরকে সতর্ক করে দিয়েছেন। অতএব প্রত্যেকের কর্তব্য হলো, নিজেদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা এবং পরস্পর ঈমান-আমলের আলোচনা করা। যেন কোন বাতিল শক্তি আমাদের ঈমানী দৌলত ছিনিয়ে নিতে না পারে। আল্লাহ তাআলা আমাদের হেফাজত করুন, আমিন।
0 মন্তব্য রয়েছে