ইসরাইলের আগুন

ইসরাইলের আগুন, ফিলিস্তিনের ছায়া -বিশ্বের বিবেক কোথায়?

ফিলিস্তিন! এটি এখন এক বিধ্বস্ত ও বিপর্যস্ত জনপদের নাম। বিশ্ব মানচিত্রে একটি স্বাধীন দেশের মান পেলেও ফিলিস্তিন এখন এক উন্মুক্ত কারাগার। বাতাসের তরঙ্গে “ফিলিস্তিন” নামটি যখন কোন সুস্থ মানুষের কানে ভেসে আসে হৃদয় তখন বেদনাহত হয়। স্মৃতিপটে ভেসে উঠে মানবতাহীন নির্দয় ইহুদীদের হামলায় বিপর্যস্ত গাজা উপত্যকার বিধ্বস্ত চাহনিগুলো। সেখানে এখন সন্তান হারা মায়ের বুকফাটা আর্তনাদে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত। প্রায়ই দেখা যায় হারিয়ে যাওয়া সন্তানের ছিন্ন ভিন্ন লাশ খুঁজে পেয়ে বাবার গাম্ভীর্য্য মাখা চেহারা ঠুকরে নেমে আসা অশ্রুবিন্দুগুলো কপাল বেশ ঝরে পড়ছে। ছোট্ট শিশু-যাদের শৈশব হয় দুরন্তপনায় ছুটে চলায়-ফিলিস্তিনের শিশুরা এখন প্রিয়জনদের লাশ খুঁজে বেড়ায়। তাদের মাথার উপর আকাশ থাকলেও সেখানে আর রংধনু নেই। সে আকাশ এখন বোমের কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন। এখনো বাবারা হাঁটে কিন্তু তাদের আঙ্গুল ধরে হাটার মত কোন সন্তান নেই। সন্তানেরা বাবার কোলে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করছে । সেখানে মায়েরা এখন আর সকালে উঠে সন্তানের প্রিয় খাবার তৈরিতে ব্যস্ত হয় না। তারা ব্যস্ত হয় সন্তানের নিথর দেহের খোঁজে। যে বয়সে সন্তানরা মায়ের কোলে তৃপ্তির নিদ্রায় রাত্রিযাপন করে, সে বয়সে গাঁজার প্রতিটি শিশুর চোখের পাতা ভারী হয়ে আর একটি সূর্য দেখার আশঙ্কা নিয়ে। তাদের প্রতি এমন অত্যাচার,এমন নির্যাতন কেবল ইসলাম গ্রহণ করার জন্য। গাজার প্রতিটি মানুষের বুক ঝাঁঝরা করা হয় কারণ তারা “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” সাক্ষ্য দিয়েছে বলে।

ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই আধুনিক ইতিহাসে শুরু হয় রক্তাক্ত এক অধ্যায়। তারা যুগে যুগে ফিলিস্তিনের মুসলমানদের উপর হামলা করে বৃদ্ধি করেছে লাশের সংখ্যা। তাদের জঘন্য হত্যাকাণ্ডে আমেরিকা পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করছে। আমেরিকা কখনো যুদ্ধাস্ত্র দিয়ে আবার কখনো মৌখিক বক্তব্যের মাধ্যমে ইজরাইলের পাশে দাঁড়াচ্ছে। বিপরীতে ফিলিস্তিন সম্পূর্ণ একা। বিভিন্ন মুসলিম দেশ ও জাতি মৌখিকভাবে ফিলিস্তিনের পক্ষে থাকলেও কার্যত কেউ তাদের পাশে নেই। বড় বড় মুসলিম দেশের কাছে অসংখ্য আধুনিক যুদ্ধাস্ত্র এবং পারমাণবিক বোমা থাকার পরও তা ফিলিস্তিনের মুসলমানদের কোন কাজে আসেনি। তারা সে সকল অস্ত্র নিয়ে নিজেদের আত্মরক্ষায় বসে আছে। তারা পিতলের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে ঢেকুর তুলে বোধহয় ভুলে গেছে ফিলিস্তিনের মুসলমানদের ত্যাগ। এ জীবন দান শুধু এক টুকরো মাটির জন্য নয় - এ লড়াই অস্তিত্ব রক্ষার জন্য, এ লড়াই বিশ্বাস আর পরিচয় ধরে রাখার সংগ্রাম। বিশ্বমঞ্চে যখন কিছু মানুষ ব্যস্ত তাদের বিলাসবহুল আড্ডায়, তখন অন্য প্রান্তে কিছু মানুষ লড়ছে নিজের অস্তিত্ব নিয়ে। এমন এক সময়ে দাঁড়িয়ে, এ প্রশ্ন উঠবেই-কীভাবে তারা ভুলে যায় সেই ত্যাগ, যে ত্যাগ কেবল ভূখণ্ডের জন্য নয়, বরং একটি জাতির আত্মার চেতনাকে রক্ষা করার জন্য? এ যুদ্ধ কেবল ফিলিস্তিনের পরাজয় নয়, এটি বস্তুত পুরো মুসলিম বিশ্বের পরাজয়। ফিলিস্তিনের উপর ইসরাইলের প্রতিটি বোমা, প্রতিটি গুলি যেন আঘাত হানে বিশ্ব মুসলিমদের অস্তিত্বে। প্রতিদিনের সহিংসতা, ধ্বংস আর নির্যাতনের এই চিত্র শুধু একটি অঞ্চলের ট্র্যাজেডি নয়, বরং তা হয়ে উঠেছে বিশ্ব মুসলিম জাতির আত্মার ক্ষরণ। এ যুদ্ধের আড়ালে স্পষ্ট হয়ে উঠছে একটি সুপরিকল্পিত প্রচেষ্টা-একটি জাতিকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার, একে একে নিভিয়ে দেওয়া তার অস্তিত্বের সব আলো। বিশ্বের চোখ যখন আরামদায়ক নিরবতায় ডুবে থাকে, তখন প্রশ্ন জাগে-এই নীরবতা কি পরাজয়েরই অন্যরকম স্বাক্ষর?

ফিলিস্তিনের প্রতি ইসরাইলের বর্বরতায় জাতিসংঘ নিরব সমর্থন জানিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বের যে কোন পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের ভূমিকা লক্ষ্য করার মত। পত্রিকা থেকে নিয়ে News Chennel সর্বত্রই তাদের বিভিন্ন বক্তব্য ও আর্টিকেল প্রকাশ হতে থাকে। কিন্তু ফিলিস্তিনের বেলায় তারা যেন তাদের দায়িত্বের কথা ভুলে যায়। গত সাত‌ই অক্টোবর, ২০২৩ থেকে চলমান নির্যাতনের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের উল্লেখযোগ্য কোন পদক্ষেপ মানুষের সামনে আসেনি। এই হল জাতিসংঘ, আর এই হল তাদের মানবাধিকার!

ইসরাইল ফিলিস্তিনি সকল খবরাখবর থেকে বিচ্ছিন্ন রাখার পায়তারায় সকল গণমাধ্যমকে সেখান থেকে দূরে রেখেছে। যে সকল সাংবাদিক মানবতার টানে ও বিবেকের তাড়নায় ফিলিস্তিনের ভিতরের সত্য খবর, সত্য পরিস্থিতি মানুষের সামনে তুলে ধরতে চেয়েছে, এর বিনিময়ে তাদেরকে নিজের প্রাণ দিতে হয়েছে। “আনাস জামাল শরীফ।“ তাকে আগেই জানিয়ে দেওয়া হয় সংবাদ প্রচার করলে নিজের জীবন দিতে হবে। তিনি রাজি হয়ে যান। নিশ্চিত মৃত্যুর কোণে দাঁড়িয়ে তিনি লিখে গিয়েছেন এক হৃদয় বিধান পত্র তিনি লিখেছেন “এটি আমার ওসিয়ত ও শেষ বার্তা এই বার্তা আপনার কাছে পৌঁছালে বুঝে নেবেন ইসরাইল আমাকে হত্যা করে আমার কণ্ঠস্বর স্তব্ধ করতে সক্ষম হয়েছে।” মনে হতে পারে তিনি এমনটি না করলেও পারতেন! কিন্তু ফিলিস্তিনের নির্যাতিত মানুষের আর্তনাদ ছোট্ট শিশুদের নিষ্পাপ দেহ হাজার হাজার টন বোমা ও মিসাইলের আঘাতে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে শূন্যে ভেসে ওঠার বিভৎস চিত্র তাকে চুপ থাকতে দেয়নি। তাদের মত অজানা বহু মানুষের বীরত্ব বিশ্ব মুসলিমের ঈমানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে

৩১ জুলাই, আল জাজিরার একটি প্রতিবেদন থেকে উঠে এসেছে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক সেনাপ্রধান আগুইলার, যিনি জি এইচ এফ (GHF)-এর পক্ষে গাজার মানবিক ত্রাণ বিতরণে নিয়োজিত ছিলেন, তাঁর চোখের সামনেই ঘটে যায় এক মর্মান্তিক ঘটনা-এক শিশু প্রাণ হারায়, প্রতীক হয়ে দাঁড়ায় পুরো ফিলিস্তিনের নির্মম বাস্তবতার।

মাত্র ৮ বছরের ছোট্ট শিশুটি। পায়ে ছিল না জুতা, ঠোঁটে ছিল অনাহারের ক্ষরণ, আর চোখে ছিল অপেক্ষার এক বিস্বাদ নীরবতা। ১২ কিলোমিটার দূরে ত্রাণ বিতরণের খবর কানে পৌঁছায়, দৌঁড়ে আসে সে-অতল ক্ষুধা আর বেঁচে থাকার আশায়। দীর্ঘ অপেক্ষার পর হাতে পায় একমুঠো ডাল আর কিছু চাল। ততক্ষণে তার মলিন মুখে ফুটে ওঠে এক স্বর্গীয় হাসি-একটি শিশুর নির্ভেজাল আনন্দ, যা বেঁচে থাকার সবচেয়ে বড় প্রমাণ।

কিন্তু ফিলিস্তিনে শিশুর হাসি দীর্ঘস্থায়ী হতে দেয় না বারুদের গর্জন। মুহূর্তেই ইসরায়েলের বর্বর আঘাতে কেঁপে ওঠে চারপাশ, আর রক্তে রাঙা হয়ে যায় গাজার বালির মাটি। শিশুটির মুখ থেকে শেষ যে শব্দটি উচ্চারিত হয়েছিল, তা ছিল: "আম্মু" এই একটি দৃশ্যই যেন বলে দেয় গাজার মানুষের প্রতিদিনের জীবনকাহিনী-ত্রাণের আশায় প্রাণ বিসর্জনের গল্প। এই নির্মমতা কেবল একটি শিশুর জীবন কেড়ে নেয়নি, কেড়ে নিয়েছে বিবেকের শেষ বিন্দুটুকু। এমন অসংখ্য করুন মৃত্যুর পরও মানবতার ত্রাণকর্তার দাবিদাররা চুপ করে থাকে। তাদের মানবতা এখানে এসে তার সংজ্ঞা ভুলে যায়। তাদের মানবতা যেন নির্ধারিত কিছু জাতিগোষ্ঠীর জন্য।

“সাধারণ মানুষ এক্ষেত্রে কিবা করতে পারে” এমন প্রশ্ন কেবলই এড়িয়ে যাওয়ার জন্য। ইসরাইলি শক্তির বিরুদ্ধে হয়তো সাধারণ মানুষের অস্ত্র যুদ্ধে যাবার সামর্থ্য নেই। কিন্তু তাদের অর্থনৈতিক ভীত নড়বড়ে করে তোলার সাধ্য আছে সাধারণ জনতার। সামাজিক জীবনের বিভিন্ন কাজ; যেমন: ক্রয়-বিক্রয় ইত্যাদি ক্ষেত্রে ইসরায়েলের সকল পণ্য বয়কট করা যেতে পারে। তাদের সবচেয়ে শক্তিশালী স্থান-সুদী ব্যবস্থাপনা-থেকে সম্পূর্ণরূপে ফিরে আসলে তারা অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়বে। কিন্তু বড় পরিতাপের বিষয় হলো যখন কোন রেস্টুরেন্ট বা খাবারের দোকানে ইসরাইলের কোন পানীয় বা খাবার পরিবেশন করা হলে তারা avoid করতে পারে না। তাদের বিবেক তখন অচল হয়ে পড়ে। তারা কি দেখেনা, ফিলিস্তিনের সেই মায়ের বুক ফাঁটা আর্তনাদ, বাবার নীরব কান্না। মৃত্যু প্রায় মায়ের জন্য পানি আনতে গিয়ে বোমা হামলায় বিধ্বস্ত এক শিশুর আকাশের দিকে উঠিয়ে দেখানো বিজয় চিহ্ন যেন ঈমানকে আরো একবার তাজা করতে চায়। ফিলিস্তিনের প্রতিটি মানুষ গাঁজার মাটির মূল্য বুঝে হয়তো এখনো তারা মনে রেখেছে বীর হামজার কথা, মনে রেখেছে বীর সালাউদ্দিন আইয়ুবীর শানিত তরবারির শেষ বিজয় আখ্যান এবং এ পবিত্র নগরীর পুনরুত্থানের ইতিহাস। তারা খালিদ বিন ওয়ালিদের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে বারবার ভেঙে পড়ার পরও হাতে অস্ত্র তুলে নেয়। তাদের এমন ত্যাগ, এমন জীবন দান কেবলই তাদের হৃদ স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের জন্য। মুসলিম উম্মাহর কর্তব্য যে কোনভাবেই হোক তাদের পাশে দাঁড়ানো। নিজেদের প্রতিটি দোয়া ও প্রার্থনায় তাদেরকে স্মরণ রাখা।

আরও পড়ুন...

0 মন্তব্য রয়েছে

একটি মন্তব্য করুন

চিন্তা করবেন না! আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশ করা হবে না।

জনপ্রিয় ব্লগ

বিভাগ

সর্বশেষ ব্লগ